মন্দারমণির বাড়বাড়ন্তে প্রশ্ন চিহ্ন পড়ে গেল।
ক্ষমতায় এসেই, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, অনন্ত বালুকাবেলা আর ঝাউবনের আড়ালে নিরিবিলি এই সমুদ্রতটকে দেশের ‘সৈকত-মানচিত্রে’ ঠাঁই দিতে হবে।
উদ্যোগের প্রথম ধাপ হিসেবে গত ডিসেম্বরে দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের আওতায় ঢুকে পড়ে শুধু মন্দারমণি নয়, লাগোয়া ছ’টি মৌজাও। কাজ শুরুর আগে, নগরোন্নয়ন দফতরের পক্ষ থেকে নিয়ম মাফিক জানতে চাওয়া হয়েছিল, মন্দারমণির লাগোয়া আর পাঁচটি মৌজা—সিলামপুর, সোনামুই, দাদনপাত্রবাড়, মানিয়া ও দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর, সৈকত-বিধি বা সিআরজেড (কোস্টাল রেগুলেশন জোন)-এর কোন পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু সে চিঠির উত্তরে মন্দারমণি-উন্নয়নের সব হিসেবই বদলে গিয়েছে।
পরিবেশ সচিব আরপিএস কাঁহালো সম্প্রতি ওই চিঠি দিয়ে নগরোন্নয়ন দফতরের সচিব দেবাশিস সেনকে স্পষ্ট জানিয়েছেন, মন্দারমণি-সহ উল্লেখিত ওই ৬টি মৌজাই সিআরজেড-১ এর আওতাভুক্ত। যার অর্থ, জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল তট উজিয়ে ওই মৌজাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় নিয়মিত। উপগ্রহ চিত্রে গত দু’দশকের যে ‘ইমেজ’ বা ছবি পাওয়া গিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতি পক্ষেই হাই-টাইডের সময়ে রামনগর-২ ব্লকের কালিন্দী পঞ্চায়েতের ওই মৌজাগুলি কার্যত বানভাসির চেহারা নেয়। ফলে, ২০১১ সালের সিআরজেড-এর নিয়ম বিধি অনুসারে, ওই ৬টি মৌজার কোথাও নির্মাণ কাজ বৈধ নয়। |
পরিবেশ দফতরের ওই চিঠির পাশাপাশি, রাজ্যের ‘ইনস্টিটিউট অফ এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’-এর (আইইএসডব্লুএম) রিপোর্টও প্রায় একই কথা বলছে। গত এপ্রিল মাসে আইইএসডব্লুএমের ডিরেক্টর অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে পরিবেশ দফতরের কাছে তাদের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। সেই রিপোর্ট বলছে, মন্দারমণি-সহ ৬টি মৌজাই ‘ইন্টার-টাইডাল এরিয়া’ অর্থাৎ হাইটাইড লাইন (ভরা জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল তট উজিয়ে যতটা পৌঁছয়) থেকে লো-টাইড লাইনের মধ্যে পড়ে। ওই এলাকায় নির্মাণ দূরস্থান, জনবসতই কাম্য নয় বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই রিপোর্ট নিয়ে অস্বস্তিতে সরকারও। পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বলেন, “এ ব্যাপারে দ্রুত কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না সরকার। যা করার তা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেই করা হবে।”
পূর্ব মেদিনীপুরের প্রশস্ত এই সমুদ্রতটের অনেকটা যে হোটেল-রিসর্টের দাপটে বেদখল হয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে ২০০৯ সালে সতর্ক করেছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। নড়েচড়ে বসে ছিল স্থানীয় প্রশাসন। বিধি ভাঙার দায়ে বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল অন্তত ৭২টি হোটেল। কিন্তু বছর ঘুরতেই, সরকারি অনুশাসন থিতিয়ে পড়তে মন্দারমণির সমুদ্রতট ঘেঁষেই ফের গজিয়ে উঠতে থাকে ছোট-মাঝারি অজস্র হোটেল। এখনও বেশ কিছু নির্মাণ কাজ চলছে। হোটেল মালিকরা অবশ্য মন্দারমণিতে নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা দেখছেন না। ‘মন্দারমণি বিচ হোটেলিয়ার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল দাস মহাপাত্রের পাল্টা দাবি, “পুরনো উপগ্রহ চিত্রের ভিত্তিতে তৈরি ওই রিপোর্টের সঙ্গে বাস্তবের মন্দারমণির কোনও মিল নেই। জোয়ারের জল এখন ওই ৬টি মৌজায় পৌঁছয় না।” তাহলে মন্দারমণি সংলগ্ন ওই মৌজাগুলি প্রতি পক্ষে বানভাসির চেহারা নেয় কেন? উত্তর মেলেনি।
রামনগর ২-এর বিডিও সুকান্ত সাহা জানান, বছর কয়েক আগেও মন্দারমণির সৈকতে হোটেল গড়তে পঞ্চায়েতের ছাড়পত্রই যথেষ্ট ছিল। তিনি বলেন, “গত বছর নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে মন্দারমণিতে অবৈধ নির্মাণ আপাতত বন্ধ। তবু এক শ্রেণির হোটেল মালিক লুকিয়ে চুরিয়ে নির্মাণ করেই চলেছেন।”
আড়েবহরে ক্রমেই বেড়ে চলা মন্দারমণির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তাই থেকেই যাচ্ছে। |