হোমগার্ড নিয়োগে ‘অনিয়মে’র প্রতিবাদ করে পদ থেকে সরতে হল রাজ্যের অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের সচিবকে। তাঁর আপত্তি খারিজ করে মন্ত্রী দফতরে নতুন কমিটির মাধ্যমে হোমগার্ড নিয়োগের প্রক্রিয়া বহাল রেখেছেন। বরং অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পর্যায়ের ওই অফিসারকে সরতে হয়েছে ‘গুরুত্বহীন’ পদে। এক আইএএস অফিসারের সঙ্গে এই আচরণে যথেষ্ট ‘প্রতিক্রিয়া’ হয়েছে আমলা মহলে। যে ভাবে বিধিনিয়মের পরোয়া না-করে বিভিন্ন দফতরের কাজ চলছে, অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে তার প্রতিবাদে মুখ্যসচিবের কাছে ও পরে রাজ্যপালের কাছে যেতে প্রস্তুত হচ্ছেন আইএএসদের একাংশ।
অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, ‘রুটিন বদলি’ ঘিরে বিতর্ক করা হচ্ছে। জাভেদের কথায়, “আইনের উপরে সরকার নয়, জাভেদ খান নয়, সচিবও নন! সব আইন মেনেই হচ্ছে।”
জঙ্গলমহলে প্রথম দফার পরে কিছু কমিশনারেট এলাকায় আরও ২২৬৮ জন হোমগার্ড নিয়োগে কয়েক মাস আগেই অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নিয়ম অনুযায়ী, হোমগার্ড ‘এনরোলমেন্টে’র প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করার কথা ডিজি (হোমগার্ড)-র। কিন্তু জাভেদের অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতর এ বারের নিয়োগ প্রক্রিয়া সামলানোর জন্য পুরনো কমিটি ভেঙে নতুন একটি কমিটি গড়েছে। যার মাথায় বসানো হয়েছে মন্ত্রীর এক ওএসডি (অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি)-কে। যাঁকে ‘সচিবের সমতুল’ পর্যায়ে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এস এল ভকত নামে ওই ওএসডি আবার চলতি বছরেরই ৩০ এপ্রিল অবসর নিয়েছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত এক আমলাকে এ ভাবে ওএসডি করে এনে নিয়োগ প্রক্রিয়ার দায়িত্বে বসানোর ঘটনা ‘নজিরবিহীন’ বলেই প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য।
ওএসডি-র নেতৃত্বাধীন কমিটি যে ভাবে হোমগার্ড নিয়োগের ‘শর্ত’ শিথিল করেছে, তাতে আপত্তি জানিয়ে মন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের কাছে ‘নোট’ পাঠিয়েছিলেন অসামরিক প্রতিরক্ষা সচিব নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে তাঁকে বলা হয়, তিনি এর পর থেকে শুধু দফতরের ‘নীতিগত ও বিধি সংক্রান্ত বিষয়’ দেখবেন। দৈনন্দিন কাজকর্ম-হোমগার্ড নিয়োগের বিষয়টি দেখবেন ওএসডি। ১৯৮১ ব্যাচের আইএএস নীহারবাবু একই সঙ্গে অসামরিক প্রতিরক্ষা ও দমকল দফতরের সচিব ছিলেন। সঙ্গে ছিল ভ্যালুয়েশন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। মন্ত্রীর সঙ্গে বিবাদের জেরে তাঁকে দুই দফতরের সচিব পদ থেকেই ‘অব্যাহতি’ দিয়ে শুধু বোর্ডের চেয়ারম্যান রাখা হয়েছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। অসামরিক প্রতিরক্ষার নতুন সচিব হিসাবে এসেছেন হৃদেশ মোহন। এক প্রশাসনিক আধিকারিকের বক্তব্য, “যদি সচিবের আপত্তি ভুলও হয়, তবে দমকল দফতরের দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরতে হল কেন? দমকল দফতরের সঙ্গে তো এর সম্পর্ক নেই! একই মন্ত্রীর অধীনে থাকা ছাড়া।” নীহারবাবু মুখ খুলতে চাননি।
মন্ত্রী জাভেদের বক্তব্য, “সচিবের নোট পেয়ে আমি আইন যাচাই করে দেখেছি। আইনমাফিক যা হতে পারে, তা-ই হচ্ছে। তা ছাড়া, হোমগার্ড নিয়োগ এখনও শুরু হয়নি।” সচিবকে সরানো নিয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “উনি সৎ, নির্ভীক অফিসার। কিন্তু কেন এক দফতরে বেশি দিন থাকতে পারেন না, রেকর্ড খোঁজ করে দেখা যেতে পারে!”
অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের একটি সূত্রের বক্তব্য: নতুন কমিটি হোমগার্ড নিয়োগে শারীরিক পরীক্ষার যে মাপকাঠি তৈরি করেছে, তাতে সময়সীমা দিয়ে বলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০০ মিটার দৌড়তে পারলেই ‘কোয়ালিফাই’ করা যাবে। ওই সূত্রের কথায়, “যা মাপকাঠি দেওয়া হয়েছে, তাতে যে কেউই দৌড়লে কোয়ালিফাই করতে পারবেন! হোমগার্ড নিয়োগের বিধি ও অর্থ দফতরের রূপরেখা মানা হচ্ছে না। তাই আপত্তি উঠেছিল। যে পথে নিয়োগ হচ্ছে, তাতে আদালতে ওই নিয়োগ যে কোনও সময় প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।” আমলা মহলের প্রতিক্রিয়া শুধুই হোমগার্ড নিয়োগের খুঁটিনাটি নিয়ে নয়। তাদের বক্তব্য, এক জন কর্মরত আইএএসের ‘বৈধ আপত্তি’ খারিজ করে অবসরপ্রাপ্ত আইএএস-কে ওএসডি করে যে ভাবে কাজ করতে চাওয়া হচ্ছে, প্রশাসন চালানোর ‘সুষ্ঠু পদ্ধতি’ সেটা নয়। আধিকারিকেরা সরকারের কাজে সহায়তা করতেই চান। কিন্তু এই ভাবে চললে সরকারি মহলে কাজের পরিবেশই নষ্ট হবে। |