|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
আমেরিকা বলে বিপাকে পড়লেন |
ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের অপরাধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কুড়ি বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে
ম্যাকিনসে’র ভূতপূর্ব কর্ণধার রজত গুপ্তের। ভারত হলে সম্ভবত তাঁর কোনও সমস্যাই
হত না। ইনসাইডার
ট্রেডিংকে এখানে সচরাচর অপরাধ বলেই গণ্য করা হয় না। লিখছেন
সুমিত মিত্র |
নিউ ইয়র্কে মার্কিন ব্যবসাজগতের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত ওয়াল স্ট্রিটের আশপাশে যে কিছু সফল বাঙালির দেখা পাওয়া যাবে না তা নয়। তবে রজত গুপ্তের মতো কর্পোরেট আমেরিকার শীর্ষে আরোহণ করেছেন এমন বাঙালি কেন, ভারতীয়ও খুঁজে মেলা ভার। আই আই টি-র ইঞ্জিনিয়ার, ৬৩ বছর বয়সের মধ্যে অতিক্রম করেছেন মার্কিন সমাজের সব ক’টি কাচের দেওয়াল। এক দশক জুড়ে পরিচালনা করেছেন বিশ্বের পয়লা সারির উপদেষ্টা সংস্থা ম্যাকিনসে, যার পরামর্শলাভের জন্য এককালে লালায়িত থাকত শুধু ছোটবড় শিল্পসংস্থা নয়, অনেক দেশীয় ও আঞ্চলিক সরকারও। পরিচালকমণ্ডলী বা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন নানা জাঁদরেল সংস্থার, যেমন বৃহত্তম বিনিয়োগ ব্যাঙ্ক গোল্ডম্যান সাক্স, শ্যাম্পু-সাবান সম্রাট পি-অ্যান্ড-জি, আমেরিকান এয়ারলাইনস। ক্লিন্টন দম্পতি তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু। মেলিন্ডা ও বিল গেটসের দাতব্য কার্যকলাপ ছিল তাঁর পরামর্শের উপর নির্ভরশীল।
সে সব এখন বিস্মৃত স্বপ্ন। ম্যানহাটনের এক আদালত রজতকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন ও-দেশে অর্থজগতের জঘন্যতম অপরাধের মধ্যে যা পরিগণিত, সেই ইনসাইডার ট্রেডিং-এর দায়ে। যার অর্থ: কোনও কোম্পানির শেয়ার মূল্যে পরিবর্তন ঘটাতে পারে এমন সব গোপন তথ্যের অধিকারীদের মাধ্যমে ওই সব তথ্যের কেনাবেচা। রজত জামিনে আছেন। অক্টোবরে জুরিরা আবার একত্র হবেন শাস্তি সাব্যস্ত করতে। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ২০ বছর কারাবাস।
রজত ২০০৮ সালে যখন গোল্ডম্যান সাক্স-এর ডিরেক্টর ছিলেন, তখন এক দিন বোর্ডের সভায় জানানো হয়, প্রখ্যাত লগ্নিকর্তা ওয়ারেন বাফেট নাকি গোল্ডম্যানের শেয়ারে পাঁচশো কোটি ডলার লগ্নির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খবরটি জানাজানি হলে মুহূর্তের মধ্যে কোম্পানির শেয়ারমূল্য আকাশ স্পর্শ করবে। অথচ ওই পরিচালকমণ্ডলীর সভা ভাঙার মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই রজত ফোন করেন তাঁর সিংহলি বন্ধু রাজ রাজারত্নমকে। রাজের পরিচালিত গ্যালিয়ন ফান্ড সম্পর্কে তত দিনে কানাকানি শুরু হয়েছে, তারা নাকি মূল্যসচেতন বাজারের তথ্যের নিয়মিত ক্রেতা। সে দিন রাজের সঙ্গে রজতের ফোনে কী কথা হয়েছিল তা সরকারি অভিযোগকারী জুরিদের জানাননি। তবে ওই কথোপকথনের পরমুহূর্তেই গ্যালিয়ন কিনে নেয় ২৬৭,০০০ গোল্ডম্যান শেয়ার, পর দিন বাফেটের বিনিয়োগের খবর জনগোচর হওয়ার দরুন শেয়ারমূল্য বাড়লে গ্যালিয়নের লাভ দাঁড়ায় দশ লক্ষ ডলার এক দিনে!
এই ঘটনাটি ছাড়াও, অভিযোক্তাদের মতে, আরও অসংখ্য প্রমাণ আছে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত রজতের সঙ্গে গ্যালিয়নের ‘ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশের’। জুরিরা সেটি পর্যালোচনা করবেন অক্টোবরে। যদি অভিযোগটি দাঁড়ায়, তবে তার জন্য সাজা আরও পাঁচ বছর জেল। রাজারত্নম ইতিমধ্যেই এগারো বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত। মার্কিন নাগরিক রজত গুপ্ত যদিও এখনই সুপ্রিম কোর্টে আপিলের কথা বলছেন, তবু বোঝা যায় তিনি শঙ্কিত।
আর রজত গুপ্তের প্রভাবশালী ভারতীয় বন্ধুরা? দুঃখবোধ নয়, তাঁদের এখন চলছে রজতবন্দনা, যেন তিনি যা করেছেন, তা বিন্দুমাত্র অন্যায় নয়, বরং মার্কিন শেয়ার বাজারের রক্ষাকর্তা সিকিয়োরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এস ই সি) এবং ও-দেশের বিচারব্যবস্থাই যত নষ্টের গোড়া। ভারতের ভি আই পি রজতপ্রেমীদের ওয়েবসাইট, ফ্রেন্ডস অব রজত ডটকম-এর মূল বক্তব্য, রজত এত নানাবিধ গুণের আধার যে তাঁরা তাঁকে সমর্থন করেই চলবেন, সে যা-ই বলুক মার্কিন আদালত।
কথাগুলির পিছনে শাস্তিবিধানের সময় জুরিদের প্রভাবিত করার মতো কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না, সেই বিতর্ক থাক। কিন্তু আর একটি ব্যাপারও থাকতে পারে। তা হল এই যে, অন্তত অর্থনৈতিক অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে ভারতীয় এবং পশ্চিমি ধারণার মধ্যে বিপুল প্রভেদ। ভারতের সেবি (প্রহিবিশন অব ইনসাইডার ট্রেডিং) অ্যাক্ট ১৯৯২-এ আছে গালভরা শব্দের ছড়াছড়ি। কিন্তু তার সামর্থ্য সীমিত। এ দেশের ব্যবসায়ের গোপন তথ্য থেকে সর্বাগ্রে লাভ সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ের মালিকেরা নিজেরা এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠজন। আইন অনুযায়ী ‘ইনসাইডার’ বলে গণ্য হতে হলে কোম্পানির মধ্যে যে নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটছে (যার ফলে শেয়ারমূল্যে গুরুতর পরিবর্তন ঘটা সম্ভব) তার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া চাই। তাঁদের বলা হয় ‘কানেক্টেড’ ব্যক্তি। সেই তালিকায় শুধু ডিরেক্টর বা কোম্পানি সেক্রেটারি থাকেন তা নয়। এমন যদি হয় যে কোনও বড় প্রকল্প শুরু হতে চলেছে, তবে লগ্নিকারী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তারাও কানেক্টেড। বা উপদেষ্টারা, কাঁচামালের জোগানদাররা, বিপণন ও রফতানি প্রতিষ্ঠান। একটা উদাহরণ দিই। ধরুন যদি টাটা মোটরস সিদ্ধান্ত নেয় তারা ন্যানো-র ইলেকট্রিক মডেল নির্মাণ করতে চলেছে, তবে সেই খবর জনসমক্ষে প্রচারিত হলে সঙ্গে সঙ্গেই কোম্পানির শেয়ারমূল্যে বড় রকম পরিবর্তন ঘটবে। অর্থাৎ, খবরটি এক্সচেঞ্জকে জানানোর আগে যাঁরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা সকলেই কানেক্টেড ব্যক্তি।
আসল ব্যাপারটা কিন্তু অন্য রকম। অধিকাংশ বড় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানেই মালিকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কিছু লোককে দেখা যায়। যখনই বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে, তখনই তাঁদের নামে প্রচুর শেয়ারের হাতবদল হয়। হয়তো প্রতিষ্ঠানের অধীন দু’টি কোম্পানি একত্রিত হতে চলেছে। তার জন্য স্থির হবে একটি অনুপাত। দুই বোর্ড কর্তৃক তা নির্দিষ্ট হওয়ার অনেক আগেই ‘ঘনিষ্ঠরা’ কর্তব্য সেরে নিয়েছেন। প্রত্যক্ষ ভাবে কোম্পানির সঙ্গে জড়িত না হওয়ার দরুন তাঁদের কখনওই কানেক্টেড বলে অভিহিত করা যাবে না। তাঁরা থেকে যান আইনের বাইরেই। তা ছাড়া, এ দেশে অধিকাংশ ব্যবসা সরকারি নীতির উপর নির্ভরশীল। নীতি পরিবর্তন সম্পর্কিত আগাম খবর যাঁরা পান তাঁদের মধ্যে আছেন আমলা ও রাজনীতিকরা। নিজেদের নামে না হলেও আত্মীয়স্বজনের নামে এঁদের অনেকের লগ্নি প্রতিষ্ঠান আছে। তাঁরা ইনসাইডার নন? ভারতে এ সব এত নিত্যনৈমিত্তিক যে শিল্পকর্তারা একে অপরাধ বলে স্বীকারই করতে চান না, তা সে আইনে যা-ই লেখা থাকুক।
বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান শেয়ারহোল্ডারকে যাতে বঞ্চিত করতে না পারে এবং শেয়ার কেনাবেচায় যাতে সকলের জন্য সমান সুযোগ থাকে, তা সুরক্ষিত করাই সেবি-র দায়িত্ব। একই দায়িত্ব আমেরিকায় এস ই সি-র। সেবি কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের অধীনে নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠান। ঈষৎ প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষিত হয়েছিল ইউপিএ-১ সরকারের শেষের দিকে। ২০০৭ সালে স্বাধীনচেতা অফিসার সি বি ভাবে সেবি প্রধানের আসনে বসেন। পরের বছর বোর্ডের পূর্ণ সদস্য হয়ে যোগ দেন কেরলের অর্থসচিব কে এন এব্রাহাম। তবে সে আশায় শীঘ্র ছাই পড়ে।
একটা কথা খুব আলোচিত হচ্ছে। ভারত এখন এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছে, যা ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে আমেরিকার ‘গিল্ডেড এজ’-এর সঙ্গে তুলনীয়। তখন উপরের চাকচিক্য সর্বত্র; যা ছিল না তা আইনের শাসন। বাণিজ্যে ও রাজনীতিতে তখন স্ট্যান্ডার্ড অয়েল-এর অধীশ্বর রকফেলার পরিবারের একচেটিয়া আধিপত্য। গিল্টি করা যুগ শেষ হল গণতন্ত্রের চাপে। একচেটিয়াতন্ত্র ভেঙে পড়ল শেরম্যান আইনের জন্য। এই আইনের সদ্ব্যবহার করেই বিশ শতকের শুরুতে থিয়োডোর রুজভেল্ট ভেঙে দিলেন ‘ট্রাস্ট’ নামে পরিচিত অতিকায় সব বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান।
রজত গুপ্ত হয়তো হাত কামড়াচ্ছেন ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করার জন্য। ভারতে হলে মন্ত্রীর একটি ফোনের পর কোনও প্রসিকিউটরের সাহস হত তাঁর বিরুদ্ধে এজলাসে উঠে দাঁড়ানোর? |
|
|
|
|
|