|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
শেষরক্ষার আগেই শহিদ হল পাক গণতন্ত্র |
সামরিক অভ্যুত্থান হয়নি। তার দরকারও হয়নি। বিচারবিভাগই অপকর্মটি করে
দিয়েছে। পাকিস্তানের দুর্ভাগা গণতন্ত্রের নতুন বিপন্নতার বিশ্লেষণ করেছেন
সেমন্তী ঘোষ |
কপালে কী আছে, কী হবেন তিনি, নায়ক না শহিদ বেশ কিছু কাল ধরেই এই অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন পাকিস্তানের সদ্য-পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। অনিশ্চয়তা ফুরোল। নায়ক হতে পারলেন না তিনি। দেশের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার পুরো সময়কাল অর্থাৎ ২০১৩ সালের মার্চ অবধি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলে সেই সরকারের প্রধানপুরুষ হিসেবে ইতিহাসের ভাগিদার হতেন গিলানি সেটা আর হল না। দুর্ভাগ্য, মাঝখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণে শহিদ হওয়াও হল না। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতি-বিষয়ক মামলা নতুন করে শুরু করার ব্যবস্থা কিছুতেই করছেন না গিলানি এই অভিযোগের ভিত্তিতে পাক সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তাঁকে সরিয়ে দিলেন। গিলানির পরবর্তী প্রার্থী হিসেবে দল যাঁকে স্থির করল, সেই মকদুম শাহাবুদ্দিন-কেও রাতারাতি গ্রেফতারের নোটিস পাঠাল সুপ্রিম কোর্ট, তিনিও বাতিল হয়ে গেলেন। তারও পরের প্রার্থী রাজা পারভেজ আশরফ শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হলেন। এতগুলি দাবার চাল এক সপ্তাহের মধ্যে! প্রধানমন্ত্রীর আসন দিন কয়েক রইল বেবাক খালি। অথচ গোটা দেশে তেমন কোলাহল তো চোখে পড়ল না? ক্ষোভ বা বিক্ষোভ? জনসাধারণের ভাবটা এমন, ওই তো ছিরির সরকার, থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী। বেচারা গিলানি তাই সাক্ষাৎ শহিদ হয়েও শহিদত্বের গৌরবটা অর্জন করতে পারলেন না।
শহিদত্ব অবশ্য জুটল এক জনের ভাগ্যে। তার নাম পাকিস্তানি গণতন্ত্র। তার হাঁটি হাঁটি পায়ে বেশ একটা কড়া ঘা পড়ল গত কয়েক দিনে। এর পর সন্তর্পণ চিকিৎসা ছাড়া তার পক্ষে বাঁচাই কঠিন। ঠিক, হানাহানির পীঠভূমি পাকিস্তানে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, কেউ হতাহত হননি। ঠিক, বিচারকরা বুক ফুলিয়ে বলছেন, এই দেখো, একে বলে আইনের শাসন সাধারণ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী কারও ছাড় নেই। ঠিক, সে দেশের সামরিক কর্তারা বাঁকা হেসে বলছেন, দেখো, আমরা করিনি, ওরা করেছে। সবই ঠিক। কিন্তু সব মিলিয়ে ঘটনার সুদূর-প্রভাববিস্তারী ভয়াবহতা চোখ এড়ানোর নয়। সামরিক বিভাগের লুকিয়ে-রাখা কালো হাতের কারসাজিও বুঝতে ভুল হওয়ার নয়। এই হল সে দেশের একুশ শতকের ক্যু। ‘সফ্ট ক্যু’। |
|
‘গণতন্ত্র’। গিলানি বিতাড়নে উল্লসিত আইনজীবীরা। |
২০০৮ সালে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি (পিপিপি) ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত এই সরকারের অপদার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামাজিক, সর্ব ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড় কথা, পিপিপি প্রেসিডেন্ট জারদারি যে দুর্নীতির ধ্বজা বহন করে ক্ষমতাসীন হয়েছেন, পার্টি এবং সরকারের সমস্ত স্তরে সেই দুর্নীতির নিপুণ রোপণ এবং ফলন চলেছে। মানুষ তিতিবিরক্ত। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী গিলানির বিহনে সাধারণ্যের বিক্ষোভ দেখা যায়নি।
কিন্তু, যত অপদার্থই হোক না কেন নির্বাচিত সরকার, গণতন্ত্রের রীতিনীতি মানলে বিচারবিভাগের পক্ষে কি সম্ভব, শাসনবিভাগের প্রধানকে এ ভাবে বরখাস্ত করা? সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা বহুবিস্তৃত হতে পারে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীও তো জন-নির্বাচিত? প্রেসিডেন্ট জারদারি যতই দুর্নীতিগ্রস্ত হোন না কেন, সে সব জেনেই তো পাকিস্তানের মানুষ পিপিপি-কে ভোট দিয়েছেন? এঁদের সরানোর দায় বা দায়িত্ব তো জনসাধারণের উপরই ন্যস্ত? বিশেষত পরবর্তী নির্বাচন যখন একেবারেই দোরগোড়ায়? কোনও গণতন্ত্রে বিচারবিভাগকে এতখানি ‘সক্রিয়’, এতখানি চরম হতে দেওয়া যায় কি? পাক সুপ্রিম কোর্ট যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তা গণতন্ত্রের পক্ষে বিষসদৃশ। এই বিষ পাকিস্তানের চেনা। এবং এই বিষের উপশম তার নাগালের বাইরে।
|
ঈশ্বরপ্রেরিত |
আসলে, গোটা ব্যাপারটার মধ্যে সৎ আইন বা সুবিচার ইত্যাদি খোঁজা বোকামি। খোঁজার বস্তু একটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। প্রধান বিচারপতি ইফতিকার মহম্মদ চৌধুরির ইতিহাসটিও এ জন্য মনে রাখা দরকার। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ ২০০৭ সালে এঁকে বরখাস্ত করেও আবার ফিরিয়ে আনেন, আনন্দে আত্মহারা বিচারক-সম্প্রদায় সেই সময়ে ইসলামাবাদে রাস্তায় নেমে বিজয়োৎসব করেন। শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের লড়াই প্রকট হয়ে সর্বসমক্ষে চলে আসে। তার পর থেকে, গত পাঁচ বছরে যে ভাবে দেশের প্রধান বিচারপতি দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান চালিয়ে গিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে মামলা দায়ের হওয়ার আগেই নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে রায় দিয়ে দিয়েছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে, নিজেকে তিনি প্রায় ঈশ্বর-প্রেরিত দূত মনে করেন। পাকিস্তানের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও এখন তাঁর কল্যাণে ‘সুয়ো মোতু’ (suo motu) এই ল্যাটিন কথাটি যার অর্থ ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ জেনে গিয়েছেন, এই কয়েক বছরে এত বার বিচারবিভাগের নিজেরই তৎপরতায় বিচারের রায় সরবে সদম্ভে ধ্বনিত হয়েছে। ব্যাপারটা চিত্তাকর্ষক হতে পারে, গণতান্ত্রিক নয়। আইন ও বিচারের প্রতি তাঁর যতটা টান, তার চেয়ে বেশি টান সম্ভবত তাঁর নিজের ‘ইমেজ’-এর প্রতি। এবং তাঁর নিজের আরও কিছু অ্যাজেন্ডা আছে এই যে অন্যান্য বহু গুরুতর দুর্নীতির মামলা ছেড়ে ইফতিকার চৌধুরি জারদারি ও গিলানির প্রতি মুক্তকচ্ছ ধাবিত হয়েছেন, তার পিছনেও সুবিচারের তাড়নার চেয়ে অন্য কিছু উদ্দেশ্যই সমধিক। মনে রাখা দরকার, সম্প্রতি তাঁর নিজের পুত্রও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
এও প্রায় নিশ্চিত যে এই ‘অন্য কিছু’টা হল পাক সামরিক হেডকোয়ার্টারের অঙ্গুলিচালনা। এই একটি দেশ যেখানে সর্ব রকম রাজনীতির উৎস ও মোহনা: উচ্চ সামরিক বিভাগ। এবং এই বিশেষ সরকারের ক্ষমতালাভের প্রথম প্রহর থেকেই এই সরকার সামরিক কর্তাদের বিষদৃষ্টিতে। বেনজির ভুট্টোর হত্যার পর যখন পিপিপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার গঠন করে, এবং আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সন্ত্রাস-যুদ্ধে নামে, সেই সময় থেকেই পাক সামরিক বিভাগের আশঙ্কা, তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতায় বাধা তৈরি হতে চলেছে। এই টেনশন বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছল গত বছর।
২০১১-র মে মাসে ওসামা বিন লাদেন-এর অ্যাবটাবাদের বাড়িতে সেই বিখ্যাত হানা। দেশ জুড়ে ‘দেশের সার্বভৌমতার উপর আক্রমণ’-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মধ্যেও এই ঘটনা নিয়ে যে সামরিক বিভাগ ও সরকারের মধ্যেও তীব্র টেনশন চলে সেই সময়, তার প্রমাণ ছড়িয়ে রইল ইতিউতি। তার পর, ‘দেশের সার্বভৌমতা’র প্রশ্নটি যে ভাবে চিৎকৃত হয়ে উঠল ২০১১-র নভেম্বরে আমেরিকার মিসাইল-হানায় ২৪ জন পাক সেনার নিধনকে কেন্দ্র করে, তাতেও রইল তিক্ত অভ্যন্তরীণ চাপান-উতোরের নিহিত চিহ্ন। এক দিকে আমেরিকার প্রবল চাপ ইসলামাবাদ যাতে জঙ্গি ‘হকানি নেটওয়ার্ক’-কে দ্রুত ধ্বংস করে, আর অন্য দিকে এই সব জঙ্গি-গোষ্ঠী-বিষয়ে-নির্বিকার পাক সেনাবাহিনীর চাপ আমেরিকার সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য পিপিপি প্রশাসনের অবস্থা তখন সত্যিই সঙ্গিন।
সরকার বনাম সেনা সংঘাত কতটা তীব্র হয়ে উঠেছে বুঝিয়ে দিল ‘মেমো’-কাণ্ড। ২০১১-র নভেম্বরে জানা গেল, মার্কিন দেশে পাক রাষ্ট্রদূত (অর্থাৎ জারদারির দূত!) হুসেন হাক্কানি নাকি ওবামা প্রশাসনের কাছে একটি গোপন মেমো পাঠিয়েছেন এই মর্মে যে পাক সামরিক বাহিনী পাক সরকারকে ফেলে দিয়ে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা চলছে, ওয়াশিংটন যেন তাতে বাধা দেয়। বিস্তর জলঘোলা হল, হাক্কানির চাকরি গেল, প্রেসিডেন্ট জারদারির সঙ্গে আর্মি-র সম্পর্ক তলানিতে ঠেকল, জেনারেল কিয়ানি সুপ্রিম কোর্টে তদন্ত শুরু করতে বললেন। বললেন যে “it unsuccessfully attempted to lower the morale of the Pakistan Army.” সম্ভবত এই পয়েন্ট থেকেই জারদারির বিরুদ্ধে সেনাকর্তা ও সুপ্রিম কোর্টের অশুভ মেলবন্ধন আঁটোসাঁটো চক্রান্তে পরিণত হল।
এই সময়কাল জুড়ে পাক-মার্কিন সরকারি সম্পর্কও ক্রমেই খারাপ হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন-বনাম-সেনা টেনশন যে এই আন্তর্জাতিক টেনশনকে অনেক ক্ষেত্রেই ছাপিয়ে গিয়েছে, তার প্রমাণ মিলল উইকিলিক্স-এ। দেখা গেল, প্রেসিডেন্ট জারদারি ইতিমধ্যে বহু বার বিভিন্ন মার্কিন ‘বন্ধু’দের জানিয়েছেন যে তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী বা আই এস আই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ২০১১-র ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী গিলানিও অভিযোগ এনেছেন: সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে সরানোর চক্রান্ত করছে।
|
আইনের আবরণে |
অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে সব রকম অভিযোগ বা ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের সমস্ত অগণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিগুলি একজোট হয়ে পাক সরকারের বিরুদ্ধতায় নেমেছে ২০১১-র শেষভাগ থেকেই। তার পর এই জুন মাসে যা ঘটল, ঘটনাবহুল পাকিস্তানেও পাশা উল্টে দেওয়ার এমন বিচিত্র পদ্ধতি আগে দেখা যায়নি। দিনকাল পাল্টেছে, ১৯৭৯ সালের মতো প্রধানমন্ত্রীকে ধরে সটান ফাঁসি দিলে বিশ্বজগৎ এখন ছেড়ে কথা কইবে না। কিংবা ১৯৯৯ সালে যেমন হয়েছিল, তেমনি ভাবে প্রধানমন্ত্রীর জন্য যাবজ্জীবন দণ্ডের ব্যবস্থা করে রাতারাতি সামরিক অভ্যুত্থানে দেশের হাল ধরলেও ফল ভাল হবে না। তাই, এখন ‘ক্যু’ চাইলে তা হতে হবে অন্য রকম। বিভিন্ন মহল হাত মিলিয়ে চুপচাপ। যেন ব্যাপারটা আইনের প্রশ্ন, অন্য কিছু নয়, এমন একটা ভাব। এই হল ‘সফ্ট ক্যু’ বা ‘সাংবিধানিক ক্যু’ আইনের আপাত-আবরণে বেআইনের প্রতিষ্ঠা।
পদ্ধতিটা নরম মানে যে ফলাফলটাও নরম, তা অবশ্যই নয়। বিচারের নামে এই অবিচার, সুশাসনের ধুয়ো তুলে এই অপশাসন, এটা একটা ভয়ঙ্কর আক্রমণ। এই আক্রমণ কোনও মানুষের বিরুদ্ধে নয়, একটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ভাল হোক, মন্দ হোক, সেই ব্যবস্থাটা যেহেতু ছিল গণতান্ত্রিক, তাই এই আক্রমণের বিপদ খুবই গভীর, তীব্র, ব্যাপক।
২০০৮ সালে নায়ক-এর বন্দনা পেয়ে প্রথম বারের মতো যাত্রা শুরু করে পাকিস্তানি গণতন্ত্র। ২০১২ সালটা সুস্থ ভাবে পেরোতে পারলে একটা বড়সড় সাফল্য জুটত। হল না। দৌড়ের শেষ ‘ল্যাপ’-এ এসে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে শহিদ হয়ে গেল সেই গণতন্ত্র। ভিন্ন প্রধানমন্ত্রী দিয়ে যদি পথটা শেষ পর্যন্ত পার হয়ে ২০১৩ সালের নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছনোও যায়, তাতেও এই শহিদকে বাঁচানো যাবে কি? অথচ সেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কিন্তু ভেবেছিলেন, তিনি তাঁর হাতে-তৈরি নতুন দেশটিতে গণতন্ত্রেরই ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে গেলেন সে দিন। হায় জিন্না। |
|
|
|
|
|