সেমিফাইনাল যুদ্ধ: জার্মানি বনাম ইতালি, স্পেন বনাম পর্তুগাল
মুণ্ডহীন ছক,‘ফল্স নাইন’
জিতিয়ে যাচ্ছে স্পেনকে
মুণ্ডহীন ধড় এক নাচানাচি করছে ইউরোয়। বড় লাবণ্যময় সে নৃত্য।
স্পেন বনাম ফ্রান্স শুরুর মিনিট পাঁচ আগে স্পেনের প্রথম এগারো দেখে গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন, “এ ভাবে শুধু মিডফিল্ডার নামিয়ে স্পেন চ্যাম্পিয়ন হলে তো স্ট্রাইকাররা বিলুপ্ত প্রজাতির জীব হয়ে যাবে!”
জিদানের জন্মদিনে ফরাসিদের একেবারে সম্মোহিত, কাঠপুতুল দেখাচ্ছিল স্পেনের ফুটবলের পাশে। ওই অনায়াস ২-০ জয়ের পরে ইউরো কাপ আপাতত আচ্ছন্ন এক নতুন টেকনিক্যাল প্রশ্নে। ৪-৬-০র মুণ্ডহীন ছক কতটা রাজত্ব করবে ভবিষ্যতে?
চুইংগাম তো ম্যাচ চলার সময় অনেকেই চিবিয়ে থাকেন। ক্রিকেটে ভিভ রিচার্ডস চিবোতেন। ফুটবলে অ্যালেক্স ফার্গুসনও চিবোন। দু’জনের চুইংগাম চিবোনোর মধ্যেই উচ্চারিত ঔদ্ধত্যের মুদ্রা।
বিশ্বজয়ী স্পেনের কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কিও চুইংগাম চিবোন ম্যাচ চলার সময়। ভিডিবি-র ভঙ্গিতে অসীম নির্লিপ্তি, ঔদাসীন্য মাখা। ওই ভাবলেশহীন দৃষ্টি জানে, কী স্বপ্ন সৃষ্টি হতে চলেছে। যেন ফুটবলের আলি আকবর খান। শনিবার রাতে ফরাসিরা এক ঘণ্টার মাথায় ১৫ মিনিটের ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ভিডিবি তখনও নির্লিপ্ত। বুকে হাত দিয়ে কী একটা বের করার সময় মনে হল, টেনশন কমাতে চুইংগাম জাতীয় কিছু বেরোবে। কোথায় কী? বুক পকেট থেকে কাগজ বের করে স্পেন কোচ নির্লিপ্ত নোট নিতে লাগলেন।
নোট নিলে কী কী জিনিস বেরোবে স্পেনের তিকিতাকার পাসিং-নির্যাস থেকে?

ফলস নাইন জার্সি: ৪-৬-০র সঙ্গে স্পেনের সৌজন্যে এই ইউরোর নতুন শব্দ ‘ফলস নাইন’। সাধারণত নয় নম্বর জার্সির ফুটবলারই হন দলের সেরা স্ট্রাইকার। ইতালির মতো ফ্রান্স ম্যাচেও স্ট্রাইকার ছাড়া শুরুতে নামল স্পেন। লুকোনো স্ট্রাইকারের কাজ করেন এক মিডফিল্ডার-- ফাব্রেগাস। তিনিই আসলে ‘ফলস নাইন’।
মুণ্ডহীন ছকের আসল মুণ্ড: দেল বস্কি ৪-৬-০ ছকটা এমন ব্যবহার করছেন, সেটা কখনও মনে হবে ৪-৩-৩। সামনে তখন তিন মুণ্ড-- ইনিয়েস্তা, দাভিদ সিলভা, ফাব্রেগাস। কখনও মনে হবে, ৪-২-৩-১। সামনে তখন শুধু ফাব্রেগাস। স্পেনের কখন কী চেহারা দাঁড়াবে, ফরাসি রক্ষণ এই ধাঁধা থেকে বেরোতে পারল না।

বার্সেলোনা বনাম স্পেন: বার্সেলোনার সঙ্গে স্পেনের মিল দেখছেন সবাই। দুটো দলে আসল ফারাক হল, স্পেন অ্যাটাকিং থার্ডে অত সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারে না। অত ওপেন স্পেস তৈরি করে না। একটা কারণ, স্পেনে মেসি বা ভিয়া নেই। দ্বিতীয় কারণ, দেল বস্কি গোলের সংখ্যা নয়, জয়েই সন্তুষ্ট।

পাসিং গিটারে শূন্য সিটার: স্পেন মানে এখন পাসিং, পাসিং মানে স্পেন। কিন্তু প্রধান অভিযোগ, পাসিং বন্যায় বিপক্ষকে ভাসিয়েও গোলের মুখ খুলতে পারে না বেশি। ম্যাচটা পনেরো মিনিটের ছটা অর্ধে ভাগ করা যাক। শুধু ৬০ থেকে ৭৫ মিনিটেই ফ্রান্সের বল পজেশন বেশি ছিল। বাকি পাঁচ অর্ধ স্পেনের। কিন্তু সব মিলিয়ে গোলে শট মাত্র ৫টি। ইনিয়েস্তা-জাভির পাসিং কখনও মারাত্মক অতিরিক্ত মনে হল। বিরক্তিকরও। স্পেনীয়রা অনেক দূর উঠেও অকারণ ব্যাক পাস খেলেন। জার্মান বা পর্তুগিজরা সেখানে অনেক দ্রুত তিন-চারটে পাসে ডাইরেক্ট ফুটবলে উঠে আসেন বেশি। ফরাসিরা এই সুযোগটা নিতে পারলেন না।

লাল-হলুদ বনাম সবুজ-মেরুন
• দুটো দলের ম্যাচে স্পেন ১৬ বার জিতেছে। পর্তুগাল ৬ বার। বাকি ১২ বার ড্র।
• স্পেনের কাছে হেরেই পর্তুগাল গত বিশ্বকাপে বিদায় নেয়। প্রি কোয়াটার্র ফাইনালে।
০-১ গোলে। পরে দেখা যায়, দাভিদ ভিয়ার ওই গোল অফসাইড ছিল।
• বিশ্বকাপের পরেই লিসবনে প্রদর্শনীতে পর্তুগাল ৪-০ হারায় স্পেনকে। জোড়া গোল
করা পোস্তিগার এখন চোট। ওই স্পেন দলের ৭ জন ইউরোয়।
• রোনাল্ডো এখনও স্পেনের বিরুদ্ধে গোল করতে পারেননি। রোনাল্ডো
খেলেছেন ৩টি ম্যাচ। জিতেছেন ২টি। হেরেছেন ১টি।
• পর্তুগাল দলের ৭ জন এখন খেলেন স্প্যানিশ লিগে। রিয়াল মাদ্রিদ, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ,
ভ্যালেন্সিয়া, রিয়াল জারাগোজায়। স্পেনের ৪ জন ইংল্যান্ডে, বাকিরা স্পেনেই।
জোড়া রাইটব্যাকের ছক বানচাল: ফরাসিদের কোচ, বিশ্বজয়ী ফুটবলার লরা ব্লাঁ-র এগারো দেখেই বোঝা গেছিল, তিনি রক্ষণাত্মক। কোনও বার্থেজ ছিলেন না যে তাঁর মাথায় ব্লাঁ চুম্বন করে নামলেই ফরাসিদের জয় অবধারিত। দিবাচি ও রিভেলিয়ের জোড়া রাইটব্যাক নামিয়েছিলেন ব্লা। অভিনব গেমপ্লেন। স্পেনের বাঁ দিকে ইনিয়েস্তা এবং ইওর্দি আলবার দৌড়টাকে থামাতে। তাতে লাভ হল কই? বাঁ দিক দিয়ে চারটে পাস খেলেই স্পেনের ১-০। আলবার ক্রসসেন্টার দেখে মনে হল, কেন তাঁকে নিতে বার্সেলোনা মরিয়া।

রক্ষণের সৃষ্টিশীলতা: এত সৃষ্টিশীল টিমে জোড়া রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার বুসকেতস ও জাবি আলন্সোর দরকার কেন? এই প্রশ্নটা প্রায়ই দেল বস্কিকে সামলাতে হয়। স্পেন কোচ পাত্তা দেন না। তাঁর দল গোল করে গোল ধরে রাখার খেলাই খেলে। মাঝমাঠে পাস ও বল নিয়ন্ত্রণে যায় বিপক্ষের ধৈর্য্যচুতি ঘটাতে। অন্যদের মতো রক্ষণে লোক বাড়ায় না। জাবি বা বুসকেতসের বল স্কিল অসাধারণ। ম্যাকালেলে বা ভিয়েরার মতো টিপিক্যাল রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার নন দু’জন। এ দিনও বারবার নজরে পড়লেন রিবেরি, বেঞ্জেমাকে সাধারণ করে দিয়ে।

স্পেনের আসল মস্তিস্ক: জার্মানির ওজিল, পর্তুগালের রোনাল্ডো, ইতালির পির্লো, ইংল্যান্ডের জেরার। মুণ্ডহীন স্পেনের লুকোনো মস্তিষ্ক কে? ফরাসিদের বিরুদ্ধে ফের দেখা গেল, ইনিয়েস্তাই আসল লোক। উয়েফার র্যাঙ্কিংয়ে রোনাল্ডোর পরেই দু’নম্বরে দাভিদ সিলভা। ইনিয়েস্তার জায়গা ছয় নম্বরে। ফ্রান্স ম্যাচ ফের বোঝাল, কেন বার্সেলোনায় তাঁকে রোনাল্ডিনহো ও রিকেলমের জায়গায় খেলিয়েছিলেন দুই ডাচ কোচ রাইকার্ড ও ফান গাল।

ফরাসিদের হৃদয় দখল: ফরাসিদের ঝিমধরা ফুটবলে আসল পরীক্ষা হল কি স্পেনের? প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে দীর্ঘদিন পরে ফ্রান্সকে হারানো, পরপর তিন বড় টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে ওঠাকাসিয়াস, জাভিরা উত্তেজিত। তাঁরা আবার সেমিফাইনালে কখনও হারেননি। তবে ব্লাঁর এই দলের তো হৃদয়ই ছিল না। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির সমীর নাসরিকে ফরাসি কোচ শুরুতে নামাননি। কেউ বলছেন, শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কারণে। কেউ বলছেন, ট্যাকটিক্যাল কারণে। এতে মাঝমাঠ দখলে সুবিধাই হল নাসরির ক্লাব সতীর্থ দাভিদ সিলভার।

এবং রোনাল্ডো: জিতে উঠেই কাসিয়াস, জাভি আলন্সো, রামোস, আরবিওলার মুখে তাঁদের ক্লাব সতীর্থর নাম। রোনাল্ডো। বক্সে ও বক্সের ধারে রোনাল্ডোর দক্ষতা ওই চার রিয়াল মাদ্রিদ তারকার চেয়ে কে বেশি জানে! তাঁর দলের মুণ্ড, ধড়, পা সবই রোনাল্ডো। “সেরা দল হতে গেলে সেরা ফুটবলারকে হারাতেই হবে।” দুর্দান্ত ফ্রিকিক বাঁচানো কাসিয়াসের স্বীকারোক্তি। স্পেনে রোনাল্ডোর পাল্টা হতে পারতেন তোরেস। এ দিন পরে নেমে শুধু অফসাইডই হলেন চার বার। মুণ্ডুহীন ছকে, ‘ফলস নাইন’ জার্সিতে গোল না পেলে পাসিং-স্পেনের তূণে প্ল্যান ‘বি’, প্ল্যান ‘সি’ আছে কি না, বোঝা গেল না।

রোনাল্ডোর জার্সির রং সবুজ-মেরুন। ইনিয়েস্তার লাল-হলুদ। ইউরোর সেমিফাইনাল কেমন উত্তেজক দাঁড়াবে, অন্তত কলকাতাকে বলে দিতে হবে না।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.