প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী একদা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, “জীবনে নিজের ‘স্ট্যাচার’-কে কখনও ছোট হতে দিও না।”
কথাটা বুঝিয়ে বলতে একটা গল্পও শুনিয়েছিলেন ইন্দিরা এক জন ছয় ফুট লম্বা লোককে চার দিন না খাইয়ে রাখলে লোকটি রোগা হয়ে যাবে। কিন্তু তার উচ্চতা ছয় থেকে কমে পাঁচ ফুট হবে না।
কীর্ণাহারের ব্রাহ্মণ সন্তানটি শৈশবে যখন স্কুলে যেতেন, তখন তাঁকে খালি পায়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হত। আজ তার চেয়েও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তিনি রাইসিলা হিলসে পৌঁছচ্ছেন। সব ঠিকঠাক চললে বিরাট এই রাষ্ট্রপতি ভবন এস্টেটের সাংবিধানিক মালিক হবেন তিনি। কিন্তু আপাতত তাঁর ইচ্ছা, রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশের আগে ভোট চাইতে রাজ্যে রাজ্যে সফর শুরু করা। এ যেন এক আধুনিক ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’।
কংগ্রেস নেতারা অনেকেই মনে করছেন, প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হলে আর যাই হোন প্রতিভা পাটিলের মতো হবেন না। আবার জ্ঞানী জৈল সিংহের মতো রাষ্ট্রপতি ভবনকে সরকার-বিরোধী ষড়যন্ত্রের আখড়াও বানাবেন না। কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেন, “প্রণববাবু হলেন টেক্সটবুক ম্যান। সাংবিধানিক গণতন্ত্র মেনে কাজ করাটা বোধহয় ওনার ডিএনএ-তেই আছে।” ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদটা ব্রিটেনের মহারানির মতো জাঁকজমকপূণর্র্ সাক্ষীগোপাল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বা রাধাকৃষ্ণণের যে ভূমিকা ছিল, একবিংশ শতাব্দীতে সেটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। সলমন খুরশিদ বলেন, “সংবিধানের মধ্যে থেকেও এখন প্রো-অ্যাকটিভ বা সক্রিয় রাষ্ট্রপতি হওয়া যায়।”
কী রকম? প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দিকনির্দেশ করতে পারেন। বিভিন্ন মন্ত্রিসভার নোটে নিজের মতামত দিতে পারেন। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বহু দেশেই সময় করে যেতে পারেন না। বিশেষ করে মনমোহন সিংহের দীর্ঘ বিদেশযাত্রায় আপত্তি রয়েছে। সেখানে প্রণববাবু প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন দেশে গিয়ে কূটনৈতিক দৌত্যের কাজ ভাল ভাবেই করতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
মনমোহন সিংহ এবং প্রণববাবুর সম্পর্কের রসায়নও চিত্তাকর্ষক। ইন্দিরা জমানায় যখন প্রণববাবু যখন অর্থমন্ত্রী তখন মনমোহন ছিলেন তাঁর ‘জুনিয়র’। আবার মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়ে হলেন তাঁর সিনিয়র। আবার এখন রাষ্ট্রপতি হলে সংবিধানের বিচারে প্রণবই হয়ে যাবেন মনমোহনের ‘সিনিয়র’। বলা যায়, ইন্দিরা জমানায় যে বৃত্ত শুরু হয়েছিল, সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে চলেছে। প্রণববাবু যখন প্রথমে অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন মনমোহন ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার গভর্নর। এর পর মনমোহন যখন নরসিংহ জমানায় অর্থমন্ত্রী হলেন, তখন প্রণববাবু প্রথমে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও পরে বিদেশমন্ত্রী হন। কিন্তু এক দিনের জন্যও প্রণববাবু নর্থ ব্লকে অর্থমন্ত্রীর ঘরে যাননি। আপত্তি করেছিলেন মনমোহনই। বলেছিলেন, “স্যার আপনি আসবেন না। আমিই যাব।” মনমোহন আসতেন যোজনা কমিশনে। এর পরে প্রণববাবু নর্থ ব্লকে এলেন আবার অর্থমন্ত্রী হয়েই।
বিজেপি জমানায় মনমোহন রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা ছিলেন। প্রণব ছিলেন দলের মুখ্য সচেতক। তখনও অনেক সময়ই দেখা যেত, সংসদের লাইব্রেরিতে বসে মনমোহন জার্নাল পড়ছেন। আর প্রণববাবু সকাল থেকে সন্ধ্যা রাজ্যসভা সামলাচ্ছেন। দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দু’জনেই পরস্পরের ধাত জানেন। তাই প্রধানমন্ত্রী হয়েও কখনওই প্রণববাবুর উপর ‘বস’গিরি ফলাতে যাননি মনমোহন। অর্থ মন্ত্রক পরিচালনার প্রশ্নে দু’জনের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু কখনওই প্রধানমন্ত্রী অসম্মান করেননি এই বঙ্গসন্তানকে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত মনমোহনের সাংবিধানিক ‘বস’ আপাতত তাঁর পুরনো ‘স্যার’ প্রণব মুখোপাধ্যায়ই। |