জাতীয় রাজনীতির খোলনলচে বদলে দিতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল ৪৩ বছর আগের এক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সেই স্মৃতি ফের উস্কে দিচ্ছে এ বারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। প্রার্থী বাছাইকে নিয়েই যে রকম রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই।
প্রণব মুখোপাধ্যায় বনাম এ পি জে আব্দুল কালাম? তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপি-র নতুন অক্ষ? অথবা ‘বিবেক ভোটের’ নামে যে যার রাজনৈতিক জমি শক্তি করা?
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আড়ালে রাইসিনা হিল গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সাক্ষী হচ্ছে, অনেকটা তেমনই ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে। তবে সে বার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নয়, চূড়ান্ত চাপানউতোর চলেছিল কংগ্রেসের ভিতরেই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই সে সময়ের কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা (যাদের বলা হত সিন্ডিকেট গোষ্ঠী) প্রার্থী করেছিলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, ইন্দিরার ক্রমশ বেড়ে চলা আধিপত্য খর্ব করতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কাজে লাগানো। গোটা পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন নিয়ে কার্যত দলের মধ্যেই বিদ্রোহ করেন ইন্দিরা। নতুন প্রজন্মের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ভি ভি গিরিকে (তিনি তখন উপরাষ্ট্রপতি) রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দু’পক্ষের প্রচারও তুঙ্গে ওঠে। শেষ পর্যন্ত জোরালো লড়াই করেও সামান্য ভোটে হেরে যান রেড্ডি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সেই বিরোধিতার জেরে দল ভাগ হয়ে যায়। সুকৌশলে ‘সিন্ডিকেট গোষ্ঠী’কে ইন্দিরা গাঁধী কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে। নিজেও উঠে গিয়েছিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতার শীর্ষে।
|
|
|
ভি ভি গিরি |
নীলম সঞ্জীব রেড্ডি |
|
দিল্লির রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক কোনও নতুন ঘটনা নয়। বরং তা ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট সচিবালয়ের প্রাক্তন কর্তা বি রামান জানাচ্ছেন, স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে বেছে নেওয়া নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তখনকার অবিভক্ত মাদ্রাজ রাজ্যের গভর্নর জেনারেল ছিলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে সেই রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের পক্ষ থেকে জোরালো অভিযোগ ওঠে যে তিনি ‘রাজাজি’র মনোনয়নের বিষয়টি সে ভাবে সমর্থন করছেন না। জওহরলাল দক্ষিণের নেতাদের বলেছিলেন, দ্রাবিড় আন্দোলনের ক্রমশ বাড়বৃদ্ধি ঘটছে দেখে তিনি রাজেন্দ্রপ্রসাদকে সেখান থেকে সরাতে রাজি নন। কিন্তু কংগ্রেসের একটি বড় অংশের অভিযোগ ছিল, কট্টর দক্ষিণপন্থী, স্বাধীনচেতা এবং প্রবল ধীশক্তিসম্পন্ন এই ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতিভবনে বসাতে নাকি রাজি ছিলেন না নেহরু। পরে অবশ্য রাজাজির মনোনয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিলেন জওহরলালই।
জ্ঞানী জৈল সিংহের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে (১৯৮২) না হলেও পরবর্তী সময়ে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর সঙ্গে তাঁর সংঘাত সুবিদিত। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এ কথাও বলে থাকেন যে বফর্স-ঘুষ নিয়ে অভিযোগ ওঠার পরে রাজীবের বিরোধীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্রপতি জৈল। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী রাজীবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও উঠে এসেছিল সে সময়। পরের নির্বাচনে বফর্স ঝড়েই হেরে যান রাজীব।
তবে ১৯৮৯ সালের পর থেকে জোট রাজনীতির যুগ শুরু হওয়ায় যথেষ্টই গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনের। ত্রিশঙ্কু লোকসভায় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হয়েছে রাষ্ট্রপতিদের। ১৯৯৬ থেকে ৯৯ এই সময়কালের মধ্যে বারবার সরকার ভেঙেছে, নতুন সরকার গঠন হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্ণায়কের ভূমিকা নিতে হয়েছে শঙ্করদয়াল শর্মা থেকে কে আর নারায়ণনদের।
রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের অঙ্কটি মাথায় রাখছেন সব দলের নেতারাই। সরকার তথা দলের ‘চাণক্য’ রাষ্ট্রপতি পদে থাকলে সরকার গড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যাবে বলেই মনে করছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। আবার প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো কুশলী কংগ্রেসি রাজনীতিবিদের রাইসিনা হিল-এ যাওয়া নিয়েও অ-কংগ্রেসি দলগুলির চিন্তা কম নয়। কারণ, ২০১৪-র লোকসভা ত্রিশঙ্কু হলে, প্রণববাবুর ভুমিকা সমস্যায় ফেলবে কি না, তা-ও ভাবতে হচ্ছে তাদের।
ফলে সর্বসম্মতির পথে হেঁটে পাঁচ দশকের এক রাজনীতিবিদকে, নাকি অরাজনৈতিক অন্য কাউকে রাইসিনা হিলে পাঠালেই আখেরে লাভ বেশি, বিরোধী শিবিরে এখনও চলছে সেই অঙ্ক কষা। বাড়ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে উত্তাপ।
|
সর্বসম্মতিতেই প্রণবকে রাষ্ট্রপতি চান সোমনাথ
নিজস্ব প্রতিবেদন |
প্রণব মুখোপাধ্যায় সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেই খুশি হবেনপ্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। লন্ডন থেকে এবিপি আনন্দকে এই কথা জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে অবশ্য হালকা সুরে জানিয়েছেন, তাঁর মতের কোনও দামই নেই। প্রণববাবুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন সোমনাথবাবু। সেই বার্তা প্রণববাবুর চোখে পড়েছে কি না তা অবশ্য জানেন না প্রাক্তন স্পিকার। রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে এক বার উঠেছিল সোমনাথবাবুর নামও। তাঁর মতে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের নির্বাচনে লড়া উচিত নয়। |