চার বছর আগে বামেরা তাঁর উপরে ভরসা করেছিল। তিনি কথা রাখেননি। পরমাণু চুক্তি নিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মুলায়ম সিংহ যাদব। আর এ বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধেও কথা রাখলেন না। সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে ‘গোপন’ বৈঠক করে প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই সমর্থন করলেন তিনি।
কেন এমন আচমকা মত বদলালেন মুলায়ম? সনিয়ার সঙ্গে কী রফা হল তাঁর?
গোটা রাজধানী এখন এই রহস্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত। মুলায়ম অবশ্য বলছেন, “না। সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনও রফা হয়নি।” মত পরিবর্তন সম্পর্কে সমাজবাদী পার্টির প্রধানের ব্যাখ্যা, প্রণবই তাঁর প্রথম পছন্দ ছিলেন। কিন্তু প্রণবকে প্রার্থী করতে কংগ্রেস ইতস্তত করছে দেখেই তিনি তিনটি নাম ‘প্রস্তাব’ করেছিলেন। সেগুলি কোনও ‘সিদ্ধান্ত’ নয়।
মুলায়মের এই ‘ব্যাখ্যা’ সম্পর্কে তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, মমতা-মুলায়মের যে বৈঠকে এ পি জে আব্দুল কালাম, মনমোহন সিংহ এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম ঠিক হয়েছিল, তা শুরুর আগেই গোটা দেশ জেনে গিয়েছিল, রাষ্ট্রপতি পদে সনিয়ার প্রথম পছন্দ প্রণব। তৃণমূল নেত্রীকে সেই কথাই জানিয়েছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী।
আর কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, মুলায়ম প্রথম থেকেই তাঁদের পাশে ছিলেন। কিন্তু দাবিদাওয়া আদায়ের কৌশল হিসেবে মমতার সঙ্গে সাময়িক জোট বেঁধেছিলেন। মুলায়মের এই কৌশলী চাল ভাল ফল দিয়েছে বলেই রাজধানীর রাজনীতির কারবারিদের মত।
কী ঘটেছিল বুধবার রাতে?
কংগ্রেস এবং সপা সূত্র জানাচ্ছে, যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করার আধ ঘণ্টা পরে মুলায়মের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান মমতা। তার পরেই দশ জনপথ থেকে ফোন আসে মুলায়মের কাছে। বলা হয়, সনিয়া তাঁর সঙ্গে গোপনে দেখা করতে চান। রাজি হন মুলায়ম। গভীর রাতে বৈঠকের সময়
ঠিক হয়। কিন্তু বিষয়টি গোপন রাখা যাবে কী করে? কারণ, দুই বাড়ির সামনেই থিক থিক করছে সাংবাদিক। সংবাদমাধ্যমকে এড়াতে দুই বাড়িরই পিছনের দরজা দিয়ে যাতায়াত করেন মুলায়ম।
কংগ্রেস সূত্র জানাচ্ছে, বুধবার রাতের বৈঠকেই মুলায়মের কাছ থেকে প্রণবের জন্য প্রাথমিক ভাবে সমর্থন আদায় করে নেন সনিয়া। পরে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি ও সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। মুলায়মের সমর্থন নিশ্চিত করার পরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মমতার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রণবকে সমর্থন করার কথা জানান একাধিক সপা নেতাও।
মুলায়ম মত পাল্টাতে পারেন এই জল্পনা শুরু হওয়ায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফের তাঁর বাড়ি যান মমতা। তৃণমূল শিবিরের দাবি, মুলায়মের কাছে মমতা জানতে চান, তিনি সনিয়ার সঙ্গে কোনও বৈঠক করেছেন কী না। জবাবে মুলায়ম ‘না’ বললেও তিনি যে তৃণমূলের সঙ্গে নেই, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায় মমতার কাছে। যে সপা সাংসদ কিরণময় নন্দের উপর মমতা ভরসা রেখেছিলেন তিনিও প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হন। রাতে মুলায়মের বাড়িতে দলীয় দুই দূতকে পাঠিয়ে মমতা শেষ চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে ফের বৈঠকে বসেন সনিয়া ও মুলায়ম। কংগ্রেস সভানেত্রীকে আশ্বস্ত করে মুলায়ম জানান, তাঁর দল কংগ্রেসের প্রার্থীকেই সমর্থন জানাবে। কিন্তু কীসের বিনিময়ে এই সমর্থন তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই মুখ খুলতে চায়নি কোনও পক্ষই। তবে অনেকেই মনে করছেন, এই সমর্থনের বিনিময়ে সম্ভবত একাধিক দাবি কংগ্রেসের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন মুলায়ম। যেমন, প্রথমত, তাঁর বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন যে মামলা রয়েছে, তা নিয়ে বিশেষ নাড়াচাড়া যেন না হয়। দ্বিতীয়ত, পুত্র তথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যেন রাজ্যের জন্য বাড়তি কেন্দ্রীয় সাহায্য পায়। তৃতীয়ত, ভাই রামগোপাল যাদবকে যেন কংগ্রেস উপরাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন জানায়। এই মনোমালিন্যের জেরে তৃণমূল ইউপিএ থেকে সরে গেলে মুলায়মকে রেলমন্ত্রী করা হবে বলেও নাকি টোপ দিয়েছে কংগ্রেস। যদিও এই সব সম্ভাবনা সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন সপা নেতৃত্ব।
কিন্তু প্রশ্ন হল, জাতীয় রাজনীতিতে যাকে অনেকেই ‘পাল্টি সিংহ’ বলে কটাক্ষ করেন, তাঁর সঙ্গে কেন জোট করতে গেলেন মমতা?
যার জবাবে তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রণবকে আটকাতে গেলে মমতার সামনে এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। মুলায়মের সঙ্গে বৈঠকে প্রথম পছন্দের প্রার্থী হিসেবে যাঁকে বাছা হয়েছিল, সেই কালাম সম্পর্কেও তাঁর দ্বিধা
ছিল। কালাম শেষ পর্যন্ত লড়তে রাজি হবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন মমতা। কিন্তু মুলায়ম তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, কালামের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। মমতা-মুলায়ম এক জোট হলে তিনি লড়তে রাজি আছেন। মুলায়মের কাছ থেকে নিশ্চিত আশ্বাস পেয়ে কালামের নাম চূড়ান্ত করেন মমতা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুলায়মের বিশ্বাসভঙ্গের ফলে আখেরে জাতীয় স্তরে দলের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ হল বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। |