দুই অর্থমন্ত্রী বৈঠক করলেন। কিন্তু কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়ে এল না। পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানিয়ে দিলেন, “আলোচনা শেষ হয়নি। শেষ হলে মুখ্যমন্ত্রীকে জানাব।” পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক দাবি নিয়ে ফয়সালা হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইউপিএ-র অভিন্ন প্রার্থী বাছাইয়ের প্রশ্নে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়কে পাশে পাওয়ার আশা ক্ষীণ। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী বাছাইয়ের পুরো প্রক্রিয়াটাই আপাতত পিছিয়ে দিচ্ছে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব।
রাজ্যের ঋণের বোঝা শোধ করতে প্রতি বছর যে সুদ-আসল মেটাতে হয়, তা তিন বছরের জন্য স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, এই দাবি পুরোপুরি মেনে নেওয়া অর্থ মন্ত্রকের পক্ষে সম্ভব নয়। আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি আজ যেহেতু চূড়ান্ত হয়নি, তাই রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসেবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নামে মমতার যে বিরোধী অবস্থান, তারও কোনও পরিবর্তন হয়নি। এমন নয় যে কংগ্রেস প্রণববাবুর নাম চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী ঘোষণা করতে চাইছে না কংগ্রেস। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। মমতা তাঁকে জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে তিনি সোমবারই দিল্লি এসে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব আপাতত এই নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। মমতাও এখন দিল্লি আসছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী জি-২০-র বৈঠকে যোগ দিতে ১৬ জুন মেক্সিকো যাচ্ছেন। ২৩ তারিখ তিনি দিল্লি ফেরার পরেই প্রার্থী ঘোষণা করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে প্রণব-অমিত বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এটা রুটিন মিটিং। আপনারা এই নিয়ে এত বলছেন। কিন্তু আমি মনে করি না এতে কোনও বড় পরিবর্তন (বিগ জাম্প) হবে। বরং আগে আমরা প্রত্যেক বারই ফিরেছি শূন্য হাতে।” মমতার কথায়, “বৈঠকের বিস্তারিত এখনও জানি না। তবে আমি যদি সন্তুষ্ট হই, আপনাদের বলি। না হলে বলি না।”
মমতার দাবি, আর্থিক প্যাকেজের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত এক বছর ধরেই আর্থিক সাহায্যের জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। তৃণমূল শিবিরের যুক্তি, মনমোহন সরকারই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঠিক আগে আর্থিক সাহায্য নিয়ে বৈঠক ডেকে দেখাতে চাইছে যে মমতা দর কষাকষি করছেন।
কোথায় আটকে রয়েছে আর্থিক সাহায্য নিয়ে আলোচনা? অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, মমতার দাবি ছিল, রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ দু’লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। বছরে রাজ্যকে সুদ-আসল বাবদ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা মেটাতে হয়। অথচ রাজ্যের আয় ২১ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে তিন বছরের জন্য ঋণ পরিশোধ মকুব করার দাবি জানিয়েছিলেন মমতা। রাজ্যের অর্থ দফতরের বক্তব্য, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ এখন প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৭ হাজার টাকা আসলের অংশ হিসেবে মেটানো হয়। বাকিটা যায় সুদ মেটাতে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, রাজ্য যেমন কেন্দ্রের থেকে ঋণ নিয়েছে, তেমনই খোলা বাজার থেকে ঋণ নিয়েছে। রাজ্যকে বছরে যে ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো সুদ মেটাতে হয়, তার সামান্য অংশই কেন্দ্রীয় ঋণের সুদ। খোলা বাজার থেকে ঋণের সুদ মকুব করার ক্ষমতা সরকারের হাতে নেই। সে ক্ষেত্রে এই ২৫ হাজার কোটি টাকার দায় নেওয়ার জন্য কেন্দ্রের দাবি জানিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এই বিশাল পরিমাণ অর্থের দায় নেওয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রেরও নেই। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যকে সব থেকে বেশি কী দেওয়া সম্ভব, তা আজ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নানা দিক থেকে জোগাড়যন্ত্র করে সব মিলিয়ে রাজ্যকে যে ‘প্যাকেজ’ দেওয়া যাবে, তার পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকার মতো। যা রাজ্যের দাবির মাত্র অর্ধেক। অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের যুক্তি, অমিত মিত্রই জানিয়েছেন রাজ্যের কর বাবদ আয় এ বার ২৮ শতাংশ বাড়বে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সাহায্য মিলে উন্নয়ন খাতে অর্থের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের ঋণ পাইয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হবে। মমতার অবশ্য পাল্টা অভিযোগ, বাম-জমানায় কেন্দ্রই পশ্চিমবঙ্গকে লাগামছাড়া হারে ঋণ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। এখন নতুন সরকারকে তা শোধ করতে বলা হচ্ছে। কেন্দ্র বলছে, রাজধর্ম মেনে বাম ও তৃণমূল সরকারের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু লাগামছাড়া ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়াটাও কোন রাজধর্ম, প্রশ্ন তুলছেন মমতা।
আর্থিক সাহায্য না পেলে কি মমতা রাষ্ট্রপতি পদে প্রণববাবুকে সমর্থন করবেন না? তৃণমূলের বক্তব্য, কংগ্রেস যে প্রণববাবুকেই প্রার্থী করবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? কংগ্রেস কাকে প্রার্থী করতে চাইছে, সে বিষয়ে তারা এখনও কিছুই মমতাকে জানায়নি। আজ একই কথা জানান মুলায়ম সিংহ যাদবও। সিপিএম নেতা প্রকাশ কারাটও জানিয়েছেন, আগে কংগ্রেস প্রার্থী ঘোষণা করুক। বিজেপি-ও পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। তবে কংগ্রেস প্রণববাবুকে প্রার্থী না করলে তিনি নির্দল প্রার্থী হতে পারেন কি না, সেই সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে বিজেপি-র একাংশ। তাতে বাম-বিজেপির সমর্থনেই প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। মমতাও বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তবে প্রণববাবু নির্দল প্রার্থী হলেও মমতা এখনও তাঁকে সমর্থন করার পক্ষে নন। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁর যুক্তি, যিনি পশ্চিমবঙ্গের জন্য আর্থিক সাহায্যের বন্দোবস্ত না করে রাজ্যকে বঞ্চনা করছেন, সেই প্রণববাবুকে সমর্থন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সেই ‘বন্দোবস্ত’-এর দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েই আপাতত দিল্লিতে থেকে যাচ্ছেন প্রণববাবু। ১৪ তারিখ তাঁর বদলে কাবুলে যাবেন সলমন খুরশিদ। অমিতবাবুর সঙ্গে বৈঠকের পরে এ দিন সন্ধ্যায়ও অর্থ মন্ত্রকের ব্যয়সচিব সুমিত বসুর সঙ্গে আজ ফের এক দফা আলোচনা করেন প্রণববাবু। |