|
|
|
|
পুরবোর্ড এবং দলীয়স্তরে এগরায় কোণঠাসা তৃণমূল |
অমিত কর মহাপাত্র • কলকাতা |
নন্দীগ্রামের স্মৃতি উস্কেও হলদিয়া পুরসভায় সফল হতে পারেনি শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে তৃণমূল। তিন বছর আগে পারেনি এগরা পুর-নির্বাচনেও। প্রার্থী-সংখ্যার নিরিখে মাত্র চল্লিশ শতাংশ আসনে সাফল্য পেয়ে (১০ ওয়ার্ডে জয় মাত্র ৪-এ), একশো শতাংশ সাফল্য-পাওয়া (৪-এ ৪) কংগ্রেসের কাঁধে ভর দিয়ে যৌথ ভাবে পুরবোর্ড গড়েছিল তৃণমূল। কিন্তু দীর্ঘ তেরো বছর (প্রথম দশ বছর তৃণমূল একক ভাবে) পুর-ক্ষমতায় থেকেও উন্নয়নে ব্যর্থতার দায়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে এগরা পুর-শহরেও বইছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া। দল পরিচালনা ও নেতৃত্বের সঙ্কটেও ‘ছন্নছাড়া’ ভাব তাদের। রাজ্যপাটে পরিবর্তনের পর বাম-বিরোধিতার জায়গা আর সে ভাবে না থাকায়, কংগ্রেস-বিরোধিতাই প্রধান হয়ে উঠেছে তৃণমূলের কাছে। অন্য দিকে, এই তিন বছরে অধিকাংশ কাউন্সিলরকে ‘হাতে’ নিয়ে-নেওয়া কংগ্রেসের পুরপ্রধান আমলই দিচ্ছেন না তৃণমূল বা তাদের বিরোধিতাকে। জোট-শরিকদের আকচাআকচিতে জোট-সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হলেও হলদিয়া পুরভোটের পর নতুন করে
উৎসাহিত বামেরা।
২০০৯ সালের পুর-নির্বাচনে এগরার ১৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল ৪, কংগ্রেস ৪, সিপিএম ৩, সিপিআই ২ ও ডিএসপি ১টি আসন পায়। কংগ্রেস ও তৃণমূল জেলা নেতৃত্বের যৌথ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আড়াই বছর করে তারা পুরপ্রধানের পদ নেবে। সেই অনুযায়ী প্রথম পুরপ্রধান হন কংগ্রেসের স্বপন নায়ক। উপ-পুরপ্রধান হন তৃণমূলের বীরেন নায়ক। স্বপনবাবু অবশ্য ২০১০ সালে ডিএসপি কাউন্সিলর লক্ষ্মী দাস ও ২০১২ সালে সিপিআই কাউন্সিলর দুর্গারাম শিটকে কংগ্রেসে যোগদান করাতে সফল হয়ে তৃণমূলকে আর পুরপ্রধান পদ দেওয়ার কথা ভাবছেনই না। কংগ্রেসের দাবি, আরও এক জন করে বাম ও তৃণমূল কাউন্সিলরও তাদের দিকেই ঝুঁকে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলও পুরপ্রধানের পদ দাবি করার জায়গায় নেই। |
|
রুদ্ধগতি। পথে ও উন্নয়নে। ছবি: কৌশিক মিশ্র। |
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করাচ্ছেন, ২০০৯ সালের লোকসভা-ভোটের সময় থেকে এগরার স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বকে কোণঠাসা করার কাজ শুরু করেছিলেন জেলা তৃণমূল-নেতৃত্বই। বীরেনবাবুকে সরিয়ে এগরা-১ ব্লক সভাপতি করা হয় পুরকর্মী সিদ্ধেশ্বর বেরাকে। অধিকারীরা বীরেনবাবুকে পুরপ্রধানের পদে চান না বলেই গুঞ্জন। এই অবস্থাকেই কাজে লাগিয়েছেন কংগ্রেস-পুরপ্রধান। বিধায়ক সমরেশ দাসের মাধ্যমে এগরা শহরে নতুন যে-সব নেতা-কর্মীকে তুলে আনার চেষ্টা করছেন জেলা তৃণমূল-নেতৃত্ব, তাতেও তেমন সাফল্য আসছে না। এক দিকে পঞ্চায়েতের উপপ্রধান, অন্য দিকে পুরকর্মী হওয়ার বাধ্যবাধকতায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘নীরব’ সিদ্ধেশ্বরবাবুও। ফলে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক-সঙ্কটে পড়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের জনসংযোগের সেই ঘাটতির সুযোগ নিয়ে কংগ্রেস তার সংগঠন বাড়িয়ে ফেলছে। যার ফলে পুর-এলাকায় ধীরে ধীরে কংগ্রেসই হয়ে উঠছে তৃণমূলের প্রতিপক্ষ। আর এ ব্যাপারে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন দলের সাধারণ কর্মীরা।
২০০৯-এর ভোটে তৃণমূলের পুরপ্রধান তপনকান্তি করকে হারিয়ে তৃণমূলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন ভোটাররা। দলেরই একাংশের দাবি, পুরপ্রধানের পরাজয় ও কাউন্সিলর সংখ্যা কমে যাওয়ার পরেও সতর্ক হননি দলের নেতা ও কাউন্সিলররা। একে দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার অবস্থা, তার উপর এক রকম হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতার খেসারত দেওয়া শুরু হয়েছে তৃণমূলের। যানজট, বাজার, নিকাশি সমস্যা, আর্থিক বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি, ঠিকাদার-ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজের মানের সঙ্গে আপস করা, পুরসভায় কর্মী নিয়োগ নিয়ে ‘তোলা’ তোলার অভিযোগ তৃণমূলের প্রতি আরও প্রশ্ন জাগিয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। সিপিএমের জেলা-কমিটির সদস্য তথা পুরসভার বিরোধী দলনেতা সুব্রত পণ্ডা বলেন, “হলদিয়ায় আমরা উন্নয়নের সাফল্য যেমন পেয়েছি, এগরায় তেমনই ওদের ব্যর্থতা আমাদের সুফল দেবে। আমাদের কর্মী-সমর্থকরা উৎসাহিত। জোট-বোর্ডের বিশেষত তৃণমূলের দুর্নীতি ও অপশাসন এবং বাম-প্রভাবিত ওয়ার্ডগুলির প্রতি বঞ্চনা নিয়ে আমরা আন্দোলনে নামছি।”
বীরেন নায়ক বলছেন, “পুরপ্রধানের কাজে আমরা অসন্তুষ্ট। প্রকাশ্যে প্রতিবাদও করছি। যৌথ ভাবে বোর্ড গড়া হলেও কোনও কিছুতেই সমন্বয় নেই। উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুরপ্রধান একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃণমূলকে বঞ্চিত করছেন। যার ফলে এলাকার মানুষের চাহিদা মেটাতে না পারায় আমরা সাংগঠনিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।” তৃণমূলের পুরপ্রধানের পদ পাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, “ওরা চুক্তিভঙ্গ করেছে। এটাই আমরা জনগণের কাছে প্রচার করছি। পুরপ্রধান পদের দাবি নিয়ে শহরের দলীয় সমর্থকদের গণস্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানোর কাজ চলছে জেলা-নেতৃত্বের কাছে।” পুরপ্রধান স্বপন নায়ক ও কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক মানস করমহাপাত্রের আবার বক্তব্য, “বীরেনবাবু রাজনৈতিক স্বার্থে ভিত্তিহীন অভিযোগ করছেন। তৃণমূলের নিজস্ব সাংগঠনিক সমস্যা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে বলেই সেখান থেকে মুখ ফেরানোর জন্য কংগ্রেসকে আক্রমণ করা হচ্ছে। আড়াই-আড়াই বছরের চুক্তি ভিত্তিহীন। তৃণমূলের স্বচ্ছতা থাকলে পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে দেখাক।” বীরেনবাবুর জবাব, “অনাস্থা আনলে তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলবেন বাম-বিরোধীরা। তাই আমরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচারে নামছি।” কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি যদি ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকে, তা হলে জোট-বোর্ডের পরিণতি কী হবে, সেটাও অবশ্য ভাবাচ্ছে তৃণমূলকে। |
|
|
|
|
|