নাটকীয় কোনও পরিবর্তন নেই। রয়েছে কিছু হাত বদলের প্রস্তাব। অথচ তা নিয়েও ‘জটিলতা’ দেখা দেওয়ায় সিপিএমের পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন চূড়ান্ত হল না! বল ফের পাঠিয়ে দেওয়া হল পলিটব্যুরোর কোর্টে!
পার্টি কংগ্রেসে নির্বাচিত নতুন পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে রাজ্যওয়াড়ি এবং সংগঠন-ভিত্তিক দায়িত্ব পুনর্বণ্টন হওয়াই দস্তুর। দলের কেন্দ্রীয় স্তরে কার হাতে কী দায়িত্ব থাকবে, তার একটি প্রাথমিক তালিকাও তৈরি করেছে পলিটব্যুরো। তাতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্বে অন্তত বিরাট কোনও রদবদলের প্রস্তাব নেই। কিন্তু সেই তালিকাও শেষ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়নি দিল্লিতে সদ্যসমাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে।
এক দিকে যেমন দায়িত্ব পুনর্বণ্টনের কাজ অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে, তেমনই কেরলে দলের অভ্যন্তরীণ গোলমালের কোনও সমাধান সূত্রও বার করতে পারেনি কেন্দ্রীয় কমিটি। কেরলের রাজ্য কমিটিকেই আবার আলোচনায় বসতে বলা হয়েছে। তবে টি পি চন্দ্রশেখরন হত্যা-পরবর্তী সময়ে কেরলে দলের অন্দরে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে, তার অনুসন্ধান করতে ওই রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েক জন সদস্যকে নিয়ে তদন্ত কমিশন গড়তে রাজ্য নেতৃত্বকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দায়িত্ব পুনর্বণ্টন এবং কেরল-কাণ্ডে কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না-হওয়ায় দলের অন্দরেই ‘বিস্ময়’ দেখা দিয়েছে! এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “সব বলই যদি উপরে পলিটব্যুরো বা নীচে রাজ্য কমিটির কাছে পাস করা হয়, তা হলে আর কেন্দ্রীয় কমিটি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটি কেন?”
সিপিএম সূত্রের খবর, পলিটব্যুরোর তরফে যে প্রাথমিক তালিকার কথা দলে জানানো হয়েছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘গুরুত্ব’ বেড়ে যাওয়ার কথা মহম্মদ সেলিমের। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দেওয়া ‘নোট’ অনুযায়ী, সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ‘আপাতত’ উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বে থাকবেন। সঙ্গে সেলিম। যাঁর হাতে জম্মু ও কাশ্মীরের দায়িত্বও আছে। এর অর্থ কারাট উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব ছেড়ে দিলে ভার সামলাবেন সেলিমই। হিন্দি বলয়ের দু’টি রাজ্যে কলকাতার কোনও নেতা সাংগঠনিক ভাবে দায়িত্বে থাকছেন, এই ইঙ্গিত সিপিএমের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। দলের একাংশের ব্যাখ্যা, এতে মুসলিম নেতা হিসাবে ভবিষ্যতে সেলিমের পলিটব্যুরোয় যাওয়ার পথ ‘প্রশস্ত’ হচ্ছে। আবার এ রাজ্যেরই প্রথম সারির নেতা গৌতম দেবকে এ বার আর আন্দামান বা অন্য কোনও রাজ্যের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব নেই। ফলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকলেও উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক হিসাবে বেশি সময় ব্যয় করতে হবে গৌতমবাবুকে।
পলিটব্যুরোর বাকি সদস্যদের মধ্যে সীতারাম ইয়েচুরি আগে ছাত্র ও যুব ফ্রন্টের যুগ্ম দায়িত্বে ছিলেন। এ বার তাঁকে শুধু ছাত্র সংগঠনের ভার দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। সঙ্গে রাজ্য হিসাবে মহারাষ্ট্র। যুব ফ্রন্ট দেখার কথা পলিটব্যুরোর নতুন সদস্য এম এ বেবির। সেই সঙ্গেই তাঁকে দিতে চাওয়া হচ্ছে সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট ও কর্নাটক রাজ্যের দায়িত্ব। এস আর পিল্লাই দেখবেন বিহার ও পঞ্জাব, কে আর বরদারাজন তামিলনাড়ু। বৃন্দা কারাট মহিলা ফ্রন্টের পাশাপাশি দেখবেন ঝাড়খণ্ড। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তাঁকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তাবিত হয়েছে মদন ঘোষের নাম।
কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর দুই বঙ্গজ সদস্য হান্নান মোল্লা ও নীলোৎপল বসুর জন্যও যথারীতি নির্ধারিত একাধিক দায়িত্ব। হান্নানের দায়িত্বে রাজস্থান এবং পিল্লাইকে বিহারে সহায়তা। নীলোৎপলবাবুর নাম হরিয়ানা, পিল্লাইকে পঞ্জাবে সহায়তা এবং সেই সঙ্গেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজ কর্মচারী সংগঠন, লেখক সংগঠনের দায়িত্ব সামলানোর জন্য প্রস্তাবিত।
পশ্চিমবঙ্গের পলিটব্যুরো সদস্যদের মধ্যে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ বার অসমের দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ চেয়েছেন। তাঁর বদলে ওই রাজ্য দেখতে পারেন নিরুপম সেন। সূর্যকান্ত মিশ্রের হাতে থাকার কথা ওড়িশা। আর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্য কোনও রাজ্য বা পৃথক দায়িত্ব প্রস্তাব করা হয়নি। তিনি যেমন বঙ্গ সিপিএমের ‘মুখ’ হয়ে আছেন, তেমনই থাকবেন।
সামান্য রদবদলের প্রস্তাব হলেও কিছু নতুন দায়িত্ব সকলের জন্য ‘উপযুক্ত’ কি না, এ নিয়ে এ কে জি ভবনের নেতাদের একাংশের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে বলে সিপিএম সূত্রের খবর। পলিটব্যুরোর এক সদস্যের বক্তব্য, “দায়িত্ব পুনর্বণ্টন একটা রুটিন প্রক্রিয়া। কিন্তু এর উপরেই নেতাদের কাজের মূল্যায়ন হয়। তাই সকলেই চান, ভেবেচিন্তে এগোনো হোক।” ব্যাখ্যা যা-ই হোক, কেন্দ্রীয় স্তরে ‘সিদ্ধান্তহীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সিপিএমের অন্দরে। |