পানাজির ডেম্পো হাউসে সে দিন ফুটবলার মরিসিও আফন্সোর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ডেম্পোর আরও কয়েক জন সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ইউরো কাপে কারা কাকে সমর্থন করবে? প্রশ্নটা উঠল। অবাক লাগল, কাউকেই একটা নির্দিষ্ট দলের হয়ে গলা ফাটাতে দেখলাম না।
ইউরোর আগে যদি আমায় বলেন, কোন দলটাকে অনুসরণ করবেন ডেম্পোর কোচিংয়ে? আমি বলব, জার্মানি। না, স্পেন নয়।
বছর খানেক আগে ভারতের কোচ হওয়ার পরে আমি বলেছিলাম, ভারতীয় দলকে বার্সেলোনার স্টাইলে খেলাতে চাই। আমার এই মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছিল। অনেকে অনেক কথা বলেছিল। আমি কিন্তু কখনও বলিনি, ভারত বার্সেলোনার মতো খেলবে। বোঝাতে চেয়েছিলাম, ওই স্টাইলটা অনুসরণের চেষ্টা করা যাক। এ বার ইউরোর মুখে আমার জার্মানির স্টাইলটা ভাল লাগছে।
প্রথম দিকটায় জার্মানদের প্রতি আমার আদৌ আস্থা ছিল না। দু’দিন আগেও মনে হচ্ছিল, জার্মানি পারবে না। ৫ গোল হজম করল ক’দিন আগে। ডিফেন্স নড়বড়ে। কিন্তু জার্মানির শেষ ম্যাচটা দেখে আমি মুগ্ধ। ওজিল, লাম, মুলার, গোমেজের মতো প্রচুর খেলা ধরার লোক দলটায়। ঝপ করে আস্থাটা বেড়ে গেল। মনে হল, যদি ডেম্পো এ ভাবে খেলতে পারত!
এখন তো ডেম্পোর প্র্যাক্টিস নেই। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে পানাজিতে আসতে হয় অফিস করতেই। আসার পথে মান্ডভি নদীর ধারে অনেক পরিচিত গোয়ানের সঙ্গে দেখা হয়। বেশির ভাগ কিন্তু একটা টিমের নাম করেন। পর্তুগাল। গোয়ার সঙ্গে পর্তুগালের অতীতের সম্পর্কটা কাজ করে ফুটবলে। গোয়ার বাইরের সাংবাদিকরা ধরে নেন, আমিও পর্তুগালের সমর্থক। মনে আছে, ২০০৪ সালে ইউরো কাপে পর্তুগাল ইউরো ফাইনালে ওঠার সময় আমাদের রাজ্য জুড়ে সে কী উৎসাহ!
আমার পরিচিত পর্তুগাল সমর্থকদের জন্য দুঃখ হচ্ছে। আমি কাউকে নিরুৎসাহ করতে চাই না। কিন্তু ‘গ্রুপ অব ডেথ’ থেকে পর্তুগালের পরের রাউন্ডে যাওয়ার আশা দেখছি না। একক দক্ষতায় বড় টুর্নামেন্ট জেতানো যায় না। রোনাল্ডোও পারবে না। আমার সহকারী মরিসিও আফন্সো গোয়ার কিংবদন্তি ফুটবলার। মিডফিল্ডে একটা সময় ভারত কাঁপাত। তাঁরও দেখলাম, পর্তুগাল প্রীতি নেই। বলছিল, “যারা ভাল খেলবে, তাদেরই সমর্থন করব।”
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল দেখার পরে মন বলছে, এ বার ইউরো কাপে কিন্তু ওই ম্যাচটার ছাপ প্রবল ভাবে পড়বে। অনেক দলই চেষ্টা করবে, রক্ষণ আর প্রতি-আক্রমণ দিয়ে ফেভারিটদের থামানোর। কাজেই রক্ষণাত্মক ফুটবল বড় হয়ে দাঁড়াবে। |
জানি, আমার কথা শুনে অনেকে অবাক হবেন। বলবেন, ইউরোপে এ বছর গোলের বন্যা হয়েছে। লা লিগায় একশোর ওপর গোল করেছে বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ। মেসি-রোনাল্ডো মিলে প্রায় ৯৬টা গোল করেছে। প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালকে ৮-২ গোলে হারিয়েছে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। সিটি ইউনাইটেডকে ৬ গোল দিয়েছে। তা হলে ইউরোয় গোল কমবে কেন?
আমার যুক্তি পরিষ্কার। প্রথমত, লা লিগা আর প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে বিশ্বকাপ কিংবা ইউরো কাপের তুলনাই হয় না। দু’টো একেবারে আলাদা। ক্লাব ফুটবলে সাফল্যের রসায়ন দুর্দান্ত আক্রমণ। দেশের হয়ে আবার খেলার সময় সবচেয়ে জরুরি জমাট রক্ষণ। দ্বিতীয়ত, স্পেন-জার্মানি-নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে কোনও দলই ওপেন খেলবে না। সেটা করলেই বিপদ। লড়াই একপেশে হয়ে যাবে। মাথার উপর চেপে বসবে আক্রমণাত্মক দলটা। তার চেয়ে বরং চেলসির মডেল ভাল।
চেলসির মডেলটা ঠিক কী? রক্ষণাত্মক কৌশল দিয়েই আক্রমণাত্মক বায়ার্ন মিউনিখ, নাপোলি কিংবা বার্সেলোনাকে হারিয়েছে তারা। চোট-আঘাতের সমস্যা চেলসিকে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তাতেই তো সাফল্য এল।
স্পেন-জার্মানিকে আটকাতে দরকার ওই ফুটবলই। সেটাই করবে অন্য দলগুলো। ২০১০ বিশ্বকাপের খেলা মনে করতে বলছি আপনাদের। প্রথম দিকে স্পেনের আক্রমণাত্মক ফুটবল দেখে মন ভরে গিয়েছিল। দলে গোল করার লোকের কোনও অভাব ছিল না। তা সত্ত্বেও নক আউট পর্বের কোনও ম্যাচে একটার বেশি গোলে জিততে পারেনি। বিপক্ষের ন’দশ জন ফুটবলার মিলে রক্ষণ সামলালে, গোলটা হবে কী করে? ইউরোয় ওই জিনিস দেখলে অবাক হব না। স্পেন নিয়ে নানা স্বপ্ন দেখছেন অনেকে। ওদের ধারাবাহিকতা অসাধারণ। আমার মতে, ডিফেন্স কিন্তু বেশ চিন্তায় রাখবে দেল বস্কিকে। পুওলের অনুপস্থিতি টের পাবেন দেল বস্কি। আমার মতে, শুরুর দিকে গোল করতে না পারলে পরের দিকে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হবে স্পেনকে। নেদারল্যান্ডস বরং আমার কালো ঘোড়া।
চেলসি মডেলের পাশে আর এক অন্য রকম চমক থাকবে ইউরোয়। পোল্যান্ড, ইউক্রেন, রাশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্রএই দলগুলোর দিকে একটু নজর রাখবেন। পূর্ব ইউরোপের ফুটবল নিয়ে বাইরের বিশ্ব খেয়াল করে না। কিন্তু নিঃশব্দে ওদের দেশে উঠে আসছে অনেক ভাল ভাল ফুটবলার। আজ ইউরোর প্রথম দিনেই এদের তিনটে দলকে দেখব। বুঝতে পারবেন, কত ভাল ফুটবলার এই দলগুলোয়। পোল্যান্ড আর ইউক্রেনের পরিচিত আবহাওয়া এদের ভাল খেলতে সাহায্য করবে। পোল্যান্ডের তিনটে ফুটবলারকে দিয়েই কিন্তু বুন্দেশলিগা জিতেছে বোরুসিয়া ডর্টমুন্ড।
চেলসি মডেল, জার্মানদের ছন্দ, স্পেনের ধারাবাহিকতা, পূর্ব ইউরোপের চমক—আমার কাছে ইউরো কাপ বলতে আপাতত এটাই। |