গনগনে রোদ মাথায় ঘোড়দৌড়ের মাঠে ছুটছেন হাজার হাজার বেকার। একটা চাকরি পেতে গিয়ে উল্টে তাপপ্রবাহে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকে। তা সত্ত্বেও নিয়োগের পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি পুলিশকর্তারা। ভাবলেন অভিষেক পালের ‘মরণদৌড়’-এর পর, যখন আবহাওয়া তুলনামূলক ভাবে সহনীয় হয়ে এসেছে। বৃহস্পতিবার আচমকা পরীক্ষা স্থগিতের এই সিদ্ধান্ত বিস্মিত করেছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা কয়েক হাজার পরীক্ষার্থীকে।
রাজ্যে ‘রেকর্ড’ তাপপ্রবাহের কারণে স্কুলের ছুটি বাড়িয়ে দিতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশকর্মীদের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ‘ডিউটি’ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও সম্বিৎ ফেরেনি লালবাজারের। বুধবার দুপুরের ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৬ মিনিটে ১৬০০ মিটার দৌড়তে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন অভিষেক। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। একই ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন সুরেশ ভুজন নামে আরও এক পরীক্ষার্থী। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি। এর পর রাতেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পরীক্ষা বন্ধ করে দেন পুলিশকর্তারা। |
কিন্তু পরীক্ষা বন্ধের এই সিদ্ধান্তের কথা আগেভাগে জানতে পারেননি বহু দূর থেকে আসা পরীক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার সকালেই তাঁরা ভিড় করেন রেসকোর্সে। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, ‘অনিবার্য কারণে’ পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেঘলা সকালে হঠাৎ এ ভাবে পরীক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ কোচবিহারের এক যুবক বললেন, “২৫ ঘণ্টা সময় লেগেছে কলকাতায় আসতে। প্রচণ্ড গরমে পরীক্ষা চলল। আজ ভোরে বৃষ্টির পরে আবহাওয়া অনেকটাই ভাল হয়ে গিয়েছে। তা হলে কেন পরীক্ষা বাতিল করা হল?”
বৃহস্পতিবারের তুলনামূলক ভাল আবহাওয়ার কথা না হয় আগেভাগে জানতেন না পুলিশকর্তারা। কিন্তু পরীক্ষা বন্ধের এই সিদ্ধান্তটাই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ চলাকালীন কেন নিতে পারেননি তাঁরা?
এর জবাবে লালবাজারের কর্তারা অন্য রাজ্যের উদাহরণ টেনেছেন। তাঁদের বক্তব্য, দেশের অন্য রাজ্যগুলিতে এই ধরনের পরীক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরমের দিনেই হয়। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই হয়েছে। তাঁদের আরও যুক্তি, রেসকোর্স শীতকালে সচরাচর ভাড়া পাওয়া যায় না। মাঠ নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে বর্ষার সময়ে ওই মাঠ ভাড়া দেওয়ার রেওয়াজ নেই।
পুলিশে চাকরির পরীক্ষায় কয়েক লক্ষ আবেদনকারী অংশ নিচ্ছেন বলে ছোট কোনও মাঠে এই পরীক্ষা নেওয়ারও বিস্তর অসুবিধা। তাই এই সময়টাতেই পরীক্ষার সূচি তৈরি করা হয়েছে। হঠাৎ পরীক্ষা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলেই তাপপ্রবাহের মধ্যেও তা চালিয়ে যেতে হয়েছে।
তা হলে অভিষেকের মৃত্যুর পরে কী করে বন্ধ করা হল পরীক্ষা?
লালবাজারের কর্তারা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে এ সব প্রশ্ন আর তোলা সম্ভব নয়। তাই বৃহস্পতিবার পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে এসে ক্ষোভ জানালেও তাঁদের কিছু করার নেই বলেই জানিয়ে দিয়েছেন পুলিশকর্তারা।
পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ায় কী ধরনের অসুবিধায় পড়লেন এ দিন রেসকোর্সে আসা পরীক্ষার্থীরা?
পুরুলিয়া, জলপাইগুড়ি, দুই দিনাজপুরের কয়েক জন যুবকের বক্তব্য ১৩ দিন পরে তাঁদের একই ‘কল-লেটার’ নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। কিন্তু ওই দিন তো অনেকের অন্য কাজও থাকতে পারে। কেউ-কেউ কলেজের পরীক্ষা না-দিয়ে এখানে এসেছিলেন। তাঁদের দু’দিকেই সমস্যা হয়ে গেল। এমনই এক যুবক বলেলেন, “আমরা খুবই গরিব। অনেক কষ্ট করে এই টাকা জোগাড় করে পরীক্ষা দিতে এসেছি। এখন শুনছি, আবার এই পরীক্ষা দিতে আসতে হবে। এখন ভাবছি, ফের এখানে আসার টাকা জোগাড় করব কী করে?”
কলকাতা পুলিশের এক কর্তাও বললেন, পরীক্ষা বন্ধ রাখা বা পিছিয়ে দেওয়াকে অনেক পরীক্ষার্থী ভাল চোখে দেখেন না। উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, ২ জুন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ শহরে এসেছিলেন। রেসকোর্স থেকে হেলিকপ্টারে চেপে তিনি কলকাতা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। আইন-শৃঙ্খলাজনিত কারণে ওই দিন পরীক্ষা বন্ধ করতে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল পুলিশকে। সে দিন কোনও রকমে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল।
এখন পুলিশকর্তারা নড়ে বসলেও চাকরিপ্রার্থীদের চিন্তা সেই রয়েই গেল। |