রাতের ঘুম উধাও। ছেলে -মেয়েকে পরীক্ষা বৈতরণী পার করাতে প্রায় নাভিশ্বাস বাবা মায়ের।
ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় না উতরোলে জীবনটাই যে বৃথা। তাই পরীক্ষা -পাশের অভিনব ‘কল’ খুঁজে বার করেছেন অভিভাবকরা। আর সাফল্য পাওয়ার অব্যর্থ এই ওষুধে ভরসা রাখছে ছাত্রছাত্রীরাও।
গোটা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট আসন সাড়ে ৬৮ লক্ষ। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৯০ লক্ষ। দেশটার নাম চিন। কাকে ঠেলে কে ঢুকবে, তার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আর ‘গাওকাও’ অর্থাৎ পরীক্ষা -যুদ্ধে নামার আগে প্রস্তুতির জব্বর ঘটা। যা শুনলে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়।
বিশেষ ইঞ্জেকশন, পরীক্ষাকেন্দ্রের কাছের হোটেল, ছেলেমেয়েদের সামলাতে ‘ন্যানি’ আয়োজনে বাদ নেই কিছুই। দু’দিন ধরে পরীক্ষা। তার মধ্যে নকল -নবিশদের জারিজুরি নিয়েও সদা সিঁটিয়ে থাকতে হয় ‘ভাল’ ছেলেমেয়েদের। কারণ, দেশটার নাম যে চিন। সেখানে নকল করার পদ্ধতিও তো ‘হাইটেক’। ট্রান্সমিটার আর সাংঘাতিক ছোট ‘ইয়ার পিস’ বিক্রির দায়ে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে ১৫০০ জনকে।
পরীক্ষা শুরুর আগেই ছেলেমেয়েদের চাঙ্গা করতে দেওয়া হচ্ছে শক্তি -বর্ধক ইঞ্জেকশন। ক্লান্তি দূর করতে পড়ার সময় মজুত রাখা হচ্ছে ড্রিপ। ঝিমিয়ে পড়লেই শিরায় সোজা গিয়ে ঢুকবে ‘এনার্জি।’ মেয়েদের দুর্বলতা কাটাতে হরমোন ইঞ্জেকশন ! এই সব নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মনে কিন্তু কোনও ভয়ডর নেই। যায় যদি যাক প্রাণ, কুছ পরোয়া নহি। ১৯ বছরের সু হুনান যেমন বললেন, “পরীক্ষা আসছে। প্রত্যেকটা মিনিট সদ্ব্যবহার করতে হবে।”
এই প্রবেশিকা পরীক্ষা নাকি এতটাই কঠিন যে এক বারে লক্ষ্যভেদ প্রায় দুঃসাধ্য। ১৯টি বার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হয়ে গঙ্গারাম থামতে পারে। কিন্তু বছর ৪৫ -এর লিয়াং শি হাল ছাড়েননি। কলেজে ঢোকার জন্য ১৫ বার পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গিয়েছে। গত বছর ৬৪ নম্বরের জন্য হয়নি। তাই এ বারও পরীক্ষায় বসছেন লিয়াং।
আর আছেন ‘গাওকাও -বাওমু’ অর্থাৎ ‘পরীক্ষা -স্পেশ্যাল ন্যানি’। পরীক্ষার সময়ে ছেলেমেয়েদের বিশেষ দেখভালের জন্য এই সব ন্যানিদের শরণাপন্ন হচ্ছেন কর্মব্যস্ত বাবা -মা। ন্যানিদের ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক। তাঁরা রাঁধেন -বাড়েন, জামাকাপড় ধুয়ে দেন, আবার পড়ার সময় সাহায্যও করেন ছাত্রছাত্রীদের। ন্যানির জন্য বাবা -মায়ের পকেট কতটা হাল্কা হয়, তার সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও ১০ দিনের জন্য ওঁরা অন্তত ৩৫ হাজার টাকা নেন বলে চিনা সংবাদপত্রের দাবি।
যে সব বাবা -মা একটু বেশি বিত্তবান, দেশ জোড়া ৭৩০০ পরীক্ষাকেন্দ্রের কাছাকাছি তাঁরা ঘর ভাড়া করছেন ছেলেমেয়েদের জন্য। চিনের উত্তরে তিয়ানজিন শহরে এই ধরনের ঘরগুলোর চাবি হাতে পেলে বর্তে যাচ্ছেন অভিভাবকরা। এই সব ঘরের এক দিনের ভাড়া প্রায় সাত হাজার টাকা। একেবারে সাদামাটা ঘরগুলোর গুরুত্ব কিন্তু অন্য জায়গায়। আগের বছর ওই ঘরেই পড়াশোনা করে তাক -লাগানো নম্বর পেয়েছিল কেউ। যত বেশি নম্বর, তত বেশি দামি ঘর। বেজিং এক্সপেরিমেন্টাল হাই স্কুলের শিক্ষক জিন গুয়াংঝে জানালেন, প্রতি বছরই পরীক্ষার আগে ঘরগুলোর দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে আছে অন্য নম্বরের খেলাও। ঘরের নম্বর যদি হয় ৬ বা ৮, তা হলে তো কথাই নেই। কারণ চিনা রীতি অনুযায়ী ৬ সাফল্যের আর ৮ হল সম্পদের সূচক।
বিজ্ঞান আর আর্থিক সংস্কারে যে দেশ তরতর করে এগিয়ে চলেছে, সে দেশের মানুষের মনেও ‘পয়া -অপয়ার’ কু -সংস্কার জাঁকিয়ে বসেছে দেখে যতই অবাক হোন না কেন, চিনা ছেলেমেদের তাতে কিছু আসে যায় না। তাদের মন্ত্র, ‘নম্বর না পেলে, হবে না ভাল ছেলে।’ |