|
|
|
|
থামছেই না কয়লা পাচার |
নীলোৎপল রায়চৌধুরী • রানিগঞ্জ |
ওদের নাম আছে, পদবি নেই।
কাজ দিয়ে পদবি হত (যেমন অনেক ক্ষেত্রেই হয়), সকলেরই নামের পিছনে বসত ‘কয়লা’।
সন্ধে নামলেই আসানসোলে কালিপাহাড়ি মোড়ে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালে দেখা চোখে পড়ে কাঁচা কয়লা পোড়ানোর আগুন। সারা রাত চলে এই পোড়ানো। দেখভাল করে উমাশঙ্কর আর সত্যেন্দ্র।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই কয়লা আসছে ঘুষিক, ডামরার ভালুকসোঁদা এবং কালিপাহাড়ি থেকে। প্রথম দুই জায়গায় কয়লা তোলে কাজল, সুনীল আর পাপ্পুর লোকেরা। কালিপাহাড়িতে কাজ চালায় সুদন, কপিল আর নান্নে বাহিনী। তাদের পোড়া কয়লা কিনে নেয় বুড়ো আর মনীশ। সেই সঙ্গে জিতেন্দ্রও। এর বেশির ভাগটাই পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদে। অবৈধ খনি এলাকা থেকে কয়লা শহরে ঢুকছে ঊষা গ্রাম দিয়ে, বেরিয়ে যাচ্ছে পুরনো জি টি রোড ধরে সোজা আসানসোল দক্ষিণ থানার গা ঘেঁষে। আসানসোল শহরেও হোটেল, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকানে পৌঁছে যাচ্ছে সাইকেলে বা ঠেলায়।
রাজ্যে পালাবদলের পরেই নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, চোরাই কয়লার কারবার আর চলতে দেবেন না। চালু হয়েছে পুলিশ কমিশনারেট। কয়লা পাচার আগের চেয়ে স্তিমিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরোপুরি থামানো যায়নি। বরং তৃণমূলেরই কিছু নেতা তাতে ইন্ধন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। |
|
দামোদরের তলা থেকে উঠছে কয়লা। রানিগঞ্জে ওমপ্রকাশ সিংহের তোলা ছবি। |
চোরাই কয়লার কারবারে এই মুহূর্তে এক নম্বরে আছে জামুড়িয়া। স্থানীয় সূত্রের খবর, বেনালিতে বাবু, বাবলু, মোটা পণ্ডিত এবং ভিখারির তদারকিতে কয়লা উঠছে। সেখান থেকে গরুর গাড়ি আর সাইকেলে তা গিয়ে জমা হচ্ছে বোগড়া কলোনিতে। তার পরে পিক-আপ ভ্যানে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আসানসোল হয়ে ধানবাদে মহাজনের কাছে। শ্রীপুরে ছোটু, ফিরোজ, বলাই ও শিউপ্রসাদ, কৈথিতে কুরবান, দরবারডাঙায় মহসিন, ইকড়ায় সাবাব, সাতগ্রামে রয়েছে পিন্টু, শঙ্কর, স্বপন, বাবন, অশোক আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গেরা কয়লা কাটার দায়িত্বে রয়েছে। সাকরিতে সক্রিয় মুজিবুলের বাহিনী। আকলপুরে কাল্টু, মণ্ডলপুরে সাদ্দাম-লাল্টুরা ডিপো চালাচ্ছে।
কয়লার জোগান আসছে নন্ডী সংলগ্ন অবৈধ খনি থেকে। দেশের মহান এলাকায় রবিউল, প্রেমবাজারে বাবলু কয়লা কাটছে। এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, বেশ কিছু জায়গার কয়লা জমা হয় লতিফের ইটভাটায়। সেখান থেকে লরিতে তুলে তার উপরে হাজার খানেক ইট চাপিয়ে প্রকাশ্যে পাচার হয়। যদিও কেউই তা স্বীকার করেনি। হিজলগড়া, জয়নগর, দেশের মহানের কয়লা সাইকেলে-গরুর গাড়িতে অজয় পেরিয়ে ঢোকে বীরভূমে। বীজপুরে কুশ ও কীর্তন, কাঁটাগোড়িয়ায় গোষ্ঠ, বান্টি, শঙ্করদের তদারকিতে খনিমুখ গজিয়ে উঠেছে। তপসিতে কয়লা তুলছে নরেশ, চিন্ময়, বাপি। নর্থ সিহারশোলে আলাউদ্দিন।
চুরি হচ্ছে রানিগঞ্জে দামোদরের কাছে দামালিয়া প্যাচ থেকেও। নদ ঘেঁষে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের পাম্প হাউসের পিছনেও চলছে অবৈধ খনন। ভোর থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ভেলায় ভেসে এবং সাইকেলে ব্রিজের উপর দিয়ে কয়লা যাচ্ছে বাঁকুড়ায়। এর পিছনে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ রাজেশ এবং উপেন্দ্রের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ। রানিগঞ্জে টিবি হাসপাতাল আমবাগানে পঙ্কজ, নিমচায় মোটা মনোজ ও শীতল দাস, জলের ট্যাঙ্কের পিছনে টাকলা, মোটা মনোজ আর ‘কংগ্রেস’ নামে এক দুষ্কৃতীর লোকজন খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে।
বাঁশড়ায় কাজ করছে মুকসুদ ও লাতুয়া। এলাকার কিছু বাসিন্দার অভিযোগ, এই সব কয়লা ঢোকে খালিদের ইটভাটায়। সেখান থেকে লরি, পিক-আপ ভ্যানে চাপিয়ে বিভিন্ন স্পঞ্জ আয়রন কারখানা ও অন্যত্র পাঠানো হয়। তবে এ ক্ষেত্রেও কেউ তা স্বীকার করেনি। |
তৃণমূলের একাংশ কারবার
চালাচ্ছে বলেই পুলিশ বাধা দিচ্ছে না।
বংশগোপাল চৌধুরী, সিপিএম |
বাম জমানাতেও পুলিশ শাক দিয়ে
মাছ ঢাকত। সেই ধারাই চলছে।
তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়, কংগ্রেস
|
কয়লা চুরির খবর পেলেই পুলিশ তা
বন্ধ করতে অভিযান চালায়।
মলয় ঘটক, আইনমন্ত্রী, তৃণমূল |
বহু কয়লা চোর ধরা হয়েছে।
চুরি না থামা পর্যন্ত অভিযান চলবে।
অজয় নন্দ, পুলিশ কমিশনার |
|
সালানপুরে পাহাড়গোড়া, সামডি ও ডাবর ১০ নম্বর এলাকায় তদারকি করে মাধব আর স্বপন। বারাবনিতে ৫২টি গুল কারখানা। অভিযোগ, প্রায় সব ক’টিতেই আগে থেকে মজুত অবৈধ কয়লায় কাজ চলছে। সেই সঙ্গে, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে চুরি হওয়া কয়লাও ঢুকছে। সেখান থেকেই উপরে গুল চাপিয়ে পাচার করা হচ্ছে। তদারকিতে আছে কান্তা, রাজেশ, গৌতম-সহ কিছু কারবারি। বর্তমানে নিষ্ক্রিয় আসানসোল কোক ব্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সুকুমার চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, “সব গুল কারখানাই এখন বন্ধ। ফলে, সেগুলিতে অবৈধ কয়লার কারবার চলার অভিযোগও অবান্তর।”
বারাবনিরই মদনপুরে গুল কারখানার কাছে ডিপো চালাচ্ছে বশির, শঙ্কর আর আকু, ও দিকে গিরমিন্টে আকবর, সজল ও সন্দীপ। বানুড়িয়া, জামগ্রাম, দাসকেয়ারিতে অসিতের নেতৃত্বে কয়লা কাটা হচ্ছে। জমা করা হচ্ছে কেলেজোড়া মাদ্রাসার কাছে। কুলটির রামনগর কোলিয়ারি থেকে চোরাই কয়লা আসে সবনপুরে কানাইয়ের ডিপোয়। আলডি থেকে কয়লা তুলে বিহার-উত্তরপ্রদেশে পাঠাচ্ছে কামুয়া।
পাণ্ডবেশ্বরে খোট্টাডিহি খোলামুখ খনি থেকে কয়লা চুরির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠী প্রায়ই বিবাদে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে বলেও খবর। সম্প্রতি এক সংঘর্ষের পরে পুলিশ ১০ জনকে গ্রেফতারও করে। গব্বরদের গোষ্ঠীর ছত্রিশগণ্ডা ইটভাটা ওই কয়লা কিনছে বলে অভিযোগ। যদিও তারা তা মানতে নারাজ। অজয় পেরিয়ে বীরভূমের কৃষ্ণপুর ও ভীমগড়াতেও যাচ্ছে কয়লা। শোনপুর বাজারি প্রকল্পের কয়লা পৌঁছচ্ছে ভাটমোড়া জঙ্গলে। সেখানে আবার বামজমানার কুখ্যাত কয়লাচোর শামসের সেলিম আর নুর আলম ডিপো খুলেছে।
আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ অবশ্য দাবি করেন, তাঁরা যথেষ্ট সতর্ক রয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসে গড়ে দেড় হাজার টন কয়লা বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। কংগ্রেসের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) কমিটির সম্পাদক তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “রোজ পাঁচ হাজার টনেরও বেশি কয়লা পাচার হচ্ছে। আর উনি মাসে দেড় হাজার টন বাজেয়াপ্ত করছেন!” স্থানীয় নকশাল নেতা সাধন দাস এবং বিজেপি-র আসানসোল জেলা সম্পাদক পবন সিংহের অভিযোগ, বহু সময়েই পুলিশ বাজেয়াপ্ত কয়লা থানায় না নিয়ে গিয়ে স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় বিক্রি করে দিচ্ছে।
বছরখানেক আগেও যাঁর ‘দাপট’ অক্ষুণ্ণ ছিল, আসানসোলের সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী বলেন, “পুলিশ কমিশনার হয়তো পাচার বন্ধ করতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কর্মীদেরই একাংশ তৃণমূলের কিছু লোক এবং ইসিএলের কিছু রক্ষীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে অবৈধ কারবারে মদত দিচ্ছে। কিছু পুলিশ অফিসার হয়তো মনে করছেন, তৃণমূলের কিছু নেতার কথা মেনে চললে পদোন্নতি হবে।” তৃণমূল নেতা তথা আসানসোল পুরসভার চেয়ারম্যান জিতেন্দ্র তিওয়ারি পাল্টা বলেন, “আসলে সিপিএম নিজেদের আমলে যা করত, আমাদেরও তা-ই মনে করছে।” অবৈধ খনন কিছুটা কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, “পুলিশকে বলেছি, প্রতি এলাকায় দলগত ভাবে অবৈধ কয়লার কারবার বন্ধ করতে আমরা সাহায্য করব। তা সত্ত্বেও পুলিশ কেন তা বন্ধ করতে পারছে না, বুঝছি না।”
এই ‘কেন’র উত্তর অবশ্য অনেক নেতাই জানেন। |
|
|
|
|
|