|
|
|
|
হলদিয়ায় হেরেও পঞ্চায়েতে ‘দারুণ’ করার জেদ |
শুভেন্দুকে শুরু করতে হবে নতুন করে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
শেষ থেকে শুরুতে ফিরছেন শুভেন্দু অধিকারী।
হলদিয়ার লড়াইয়ে হেরে আগামী পঞ্চায়েত ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর ‘পুনর্দখলে’র লক্ষ্য স্থির করছেন তমলুকের সাংসদ তথা পূর্ব মেদিনীপুরের ‘অধিকারী সাম্রাজ্যে’র অন্যতম অধীশ্বর। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পর পঞ্চায়েত ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ দখল করে শুভেন্দুর (এবং তৃণমূলের) রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়েছিল। মঙ্গলবার হলদিয়া পুরভোটের ফলাফল তাঁকে আবার সেই বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছে। হলদিয়া ‘মুছতে’ শুভেন্দুর পূর্ব মেদিনীপুর চাই। নইলে বুধবার তিনি বলেন, “পঞ্চায়েতে দারুণ কিছু করার চেষ্টা করব।” মানে? জেলা পরিষদ আবার দখল করবেন? “দখলে তো আছেই। আসন বাড়াব প্রচুর!” বললেন সদ্য-পরাজিত শুভেন্দু। গত পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের ৫৩টি আসনের মধ্যে ৩৫টি পেয়েছিল তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিতেও ভাল ফল করেছিল। কিন্তু তখন তারা নন্দীগ্রাম-উত্তর পর্বের ‘বিরোধী’। এখন ‘শাসক’।
সম্ভবত সেই জন্যই শুভেন্দুর ‘চ্যালেঞ্জ’ও দ্বিগুণ। হলদিয়ার হারের জন্য তাঁর ‘ঔদ্ধত্য’কে দলের একাংশ দায়ী করলেও দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও শুভেন্দুর পাশে। কারণ তাঁকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ জিততেই হবে! পারলে জিতে নিতে হবে পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়াও। জঙ্গলমহল-অধ্যুষিত ওই দুই জেলায় বিধানসভা ভোটে ‘দায়িত্বে’ ছিলেন শুভেন্দু। জঙ্গলমহল মমতাকে ‘বিমুখ’ করেনি। পঞ্চায়েত ভোটে মমতা বিধানসভার পুনরাবৃত্তি (পারলে তারও অধিক) চান।
হলদিয়ার ফলাফল যে তাঁর কাছে ‘অপ্রত্যাশিত’, তা এদিন স্বীকার করে নিয়েছেন শুভেন্দু। তাঁর কথায়, “ম্যাজিক-ফিগারটা (২৬ আসনের পুরসভায় বোর্ড গড়তে দরকারি ১৪টি আসন) পাব তো ভেবেইছিলাম। তার চেয়েও বেশি আশা করেছিলাম। হয়নি।”
কেন হয়নি?
ভোটদানের পরিমাণ কম, তৃণমূলের আত্মতুষ্টি এবং দলের একাংশের প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও অন্তর্ঘাত হলদিয়ায় হারের তিন ‘প্রাথমিক কারণ’ আপাতত নির্দিষ্ট করেছেন শুভেন্দু। প্রত্যাশিত ভাবেই, এর মধ্যে কোথাও তাঁর ‘ঔদ্ধত্য’ বা ‘অপশাসনে’র কথা নেই। বরং তাঁর দাবি, হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের কোনও সংস্থার কর্তারই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। চাইলে দলের তরফে তা খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে। বস্তুত, শুভেন্দুর বক্তব্যে নাম না-করে আছে তৃণমূলের বিধায়ক শিউলি সাহার প্রতি ইঙ্গিত। আর অন্তর্ঘাতের প্রশ্নে রয়েছে তাঁর সঙ্গে দলের এক প্রথমসারির সাংসদের সঙ্গে ‘ইগো’র লড়াই। শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “ওই সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর উত্থান সহ্য করতে পারেন না। বরাবর তিনি দলের অন্দরে বিরোধিতা করেন। আসলে যাঁরা সিপিএম বা লক্ষ্মণ শেঠের বিরুদ্ধে কোনও লড়াই করেননি, তাঁরাই অন্তর্ঘাতে মদত দিয়েছেন।”
শুভেন্দু-শিবিরের এক নেতার কথায়, “শিউলি সাহা যে ভাবে ভোটের আগে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন, তার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভোটারদের মধ্যে হয়েছিল। ওই সাংবাদিক বৈঠকের সিডি তৈরি করে সিপিএম পাড়ায়-পাড়ায় দেখিয়েছিল। দলের কোন নেতার মদতে উনি সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন, তা-ও আমাদের দলে সকলেই জানেন।” দলীয় বৃত্তে শুভেন্দু দাবি করেছেন, ওই সাংবাদিক বৈঠকের পর শিউলিকে ‘ভর্ৎসনা’ করেছিলেন দলনেত্রী মমতা। কিন্তু তৃণমূলের রাজ্যনেতাদের মতে, মমতার ‘অগোচরে’ শিউলি ওই পদক্ষেপ করেননি। কারণ তার কিছু দিন আগেই শুভেন্দু সম্পর্কে ক্ষোভ জানিয়ে মমতাকে চিঠি লিখেছিলেন শিউলি।
হারের ময়না-তদন্তে নেমে শুভেন্দু-শিবির এখন বলছে, ঐতিহ্যগত ভাবে হলদিয়াতে বামপন্থীদের নাকি একটা ‘ভিত্তি’ ছিল। স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের তুলনায় তাদের নেতৃত্বও ভাল ছিল। কয়েক জন বাম কাউন্সিলার তাঁদের এলাকায় ভাল কাজও করেছিলেন। হারের পর দৃষ্টান্ত দিয়ে শুভেন্দু-অনুগামীরা বলছেন, “হলদিয়ায় সিপিএমের যে একটা সমর্থন আছে, তা সব ভোটেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরেও ২০০৭ সালে হলদিয়ায় সিপিএম হারেনি।”
বিধানসভায় অবশ্য সূতাহাটায় (হলদিয়া এলাকা যে কেন্দ্রের অন্তর্গত) জিতেছিলেন শিউলি। কিন্তু শুভেন্দু-শিবিরের বক্তব্য, বিধানসভায় শিউলিকে নিয়ে ঘরে-ঘরে প্রচার করেছিলেন শুভেন্দু। আর তখন হলদিয়া পুর-এলাকায় ভোট পড়েছিল ৯৫ শতাংশ। পুরভোটে পড়েছে ৮৭ শতাংশ। এক নেতার কথায়, “একে প্রচণ্ড গরম। তার পর রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের পরীক্ষা দিতে প্রায় ৪০০ জন এবং তাঁদের আরও ৪০০ অভিভাবক মোট ৮০০ জন ভোটার শহরে ছিলেন না।”
ময়না-তদন্তের ফলে আরও দেখা যাচ্ছে, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না-হওয়াতে কয়েকটি ক্ষেত্রে হার হয়েছে। তৃণমূল মোট ভোট পেয়েছে প্রায় ৪৭,৪০০। বামফ্রন্ট ৪৮,৩০০। কংগ্রেস ২,১৪৭ এবং বিজেপি ৩,৩০০। যার সূত্র ধরে স্থানীয় এক নেতা বলছেন, “কংগ্রেস-তৃণমূল একজোট হলে অন্তত আটটা ওয়ার্ড জিততাম। একটা ওয়ার্ডে আমরা হেরেছি ৫৯ ভোটে। অন্য একটায় ৮১ ভোটে!” হারের পর এমন ময়না-তদন্ত যে কোনও দলেই প্রত্যাশিত। ‘শাসক’ তৃণমূলে তো বটেই। কিন্তু এর থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে ‘আত্মতুষ্টি’র মেদ ছেঁটে ফেলে কি শুরুর সময়ে ফিরছেন শুভেন্দু? আগামী একটা বছর কিন্তু শ্যেনদৃষ্টিতে নজর রাখবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
|
|
|
|
|