পশ্চিমবঙ্গের পুরনির্বাচনের ফলাফলে কোনও চমক নাই। ছয়টি পুরসভার মধ্যে চারটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়, কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও একক শক্তিতে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে দুর্গাপুর ও ধূপগুড়ির মতো বাম-প্রভাবিত পুরসভা ছিনাইয়া লওয়া এক হিসাবে গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রবণতারই অনুসারী। ব্যতিক্রম হলদিয়া। লক্ষ্মণ শেঠের ‘খাস-তালুক’ বলিয়া গণ্য হলদিয়ায় বাম দুর্গের পতন একপ্রকার অবধারিতই ছিল। বস্তুত, গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনেই লক্ষ্মণ শেঠ তথা সি পি আইএম-এর বাঁশের কেল্লা ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। নন্দীগ্রামের ভূমি-উচ্ছেদ প্রতিরোধ-আন্দোলনের জেরে তৃণমূল কংগ্রেসের অভিভাবকত্বে যে জনজাগরণ সংগঠিত হয়, তাহার তোড়ে লক্ষ্মণ শেঠরা উড়িয়া যান। সামনে চলিয়া আসে পূর্ব মেদিনীপুরের আগুনখোর তৃণমূল যুব-নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য শুভেন্দু অধিকারীর নাম। ইতিমধ্যে হলদিয়ার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ লক্ষ্মণ শেঠ সপারিষদ তাঁহার সাম্রাজ্য খোয়াইয়াছেন। হতমান তিনি নানা বেআইনি কাজের দায়ে গ্রেফতার হইয়া কারাবন্দি। তাঁহার জামিন পর্যন্ত মেলে নাই, মাঝে-মাঝে জনরোষ হইতে রক্ষা করিয়া পুলিশি নিরাপত্তাবলয়ে তাঁহাকে আদালতে হাজির করাইতে হয়। সকলেই একপ্রকার ধরিয়া লইয়াছেন যে তৃণমূল কংগ্রেসের তরুণ তুর্কি শুভেন্দু অধিকারী এ বার লক্ষ্মণ শেঠের স্থলাভিষিক্ত হইতে চলিয়াছেন এবং হলদিয়া পুরসভাও অনায়াসে তৃণমূল কংগ্রেসের হস্তগত হইতে চলিয়াছে। ঠিক তখনই হলদিয়ার ভুক্তভোগী জনসাধারণ জানাইয়া দিলেন, তাঁহারা এক জন লক্ষ্মণ শেঠকে সরাইয়া অন্য একজন লক্ষ্মণ শেঠকে হলদিয়ার সিংহাসনে বসাইতে চাহেন না।
বার্তাটি তাৎপর্যপূর্ণ। অস্যার্থ, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাটি জনমনে অতিশয় বাস্তব। হলদিয়াবাসীর মনে হইয়া থাকিবে, লক্ষ্মণ শেঠ গিয়া তাঁহার স্থলে শুভেন্দু অধিকারী আসিলে সেটা কোনও পরিবর্তন হইল না, বরং সব কিছুই অপরিবর্তিতই থাকিয়া গেল। ইহা তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা। পরিবর্তন মানে শাসনপ্রণালীর পরিবর্তন, দলবাজি, স্বজনপোষণ, গুণ্ডামি, পেশি-আস্ফালনের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের পরিবর্তন। তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ হইতে বাংলার মানুষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই মৌলিক পরিবর্তন প্রত্যাশা করিয়াছে। কিন্তু হলদিয়ার মানুষ এক বছরের মধ্যেই লক্ষ করিয়াছেন, তাঁহাদের পরিবর্তনের আশা ধূলিসাৎ হইতেছে। তাঁহাদের আশঙ্কা জাগিয়াছে বুঝি বা যে যায় হলদিয়ায়, সে-ই হয় লক্ষ্মণ। এমতাবস্থায় তাঁহারা হয়তো বা নূতন শাসক দলকেও কিঞ্চিৎ শিক্ষা এবং একটি সঙ্কেত দিতে চাহিয়াছেন। পুলিশ ও রাজনৈতিক বাহুবলীরা যে ক্ষমতার উৎস নহেন, ক্ষমতার উৎস যে জনসাধারণ, এক বার ক্ষমতাসীন হইলেই শাসকেরা তাহা বিস্মৃত হওয়ার উপক্রম করেন। তাঁহাদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন হয় যে লক্ষ্মণ শেঠ কিংবা শুভেন্দু অধিকারীরা নন, ইতিহাস রচনা করেন জনসাধারণই। তাই সি পি আইএম নেতৃত্ব যখন হলদিয়া পুরসভার নির্বাচনী ফলাফলে ‘বন্দি লক্ষ্মণ শেঠের ক্ষমতা’র প্রতিফলন দেখেন কিংবা এই ফলাফলের ভিত্তিতে লক্ষ্মণ শেঠের মুক্তি দাবি করেন, তখন সেটাও হাস্যকর ও অন্তঃসারশূন্য ঠেকে। হলদিয়ার বার্তা একটাই লক্ষ্মণ শেঠ নির্বাসিত, যিনি বা যাঁহারা লক্ষ্মণ শেঠ হইতে চাহিবেন, একই পরিণতি তাঁহাদের জন্যও অপেক্ষমাণ থাকিবে। |