চার তলার ছাদে ঠাসা ভিড়। সবার চোখ আকাশের দিকে।
প্রভাতের কিনারায় শুকতারার এ দিন অন্য রূপ! লাল-হলুদ থেকে সাদাটে হয়ে যাওয়া সূর্যের গায়ে ছোট্ট কালো তিলের মতো দেখা যাবে শুক্রকে!
জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় শুক্রের সেই সরণ বা অতিক্রমণ চাক্ষুষ করতে বুধবার ভোর থেকেই সল্টলেকের পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের বাড়িতে জমায়েত শহরের বিভিন্ন প্রান্তের নানা বয়সের মানুষ।
ভোর পৌনে ছ’টা নাগাদ বাবার হাত ধরে হাজির বছর বারোর লহরী দাস। আর এক খুদে অর্চিতা মুখোপাধ্যায় গরমের ছুটিতে ইনদওর থেকে হাওড়ার শিবপুরে দাদুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। মা-দিদাকে নিয়ে হাজির সে-ও। প্রথমে অবশ্য হতাশ হয়ে পড়েছিল। কারণ, সাড়ে পাঁচটা থেকে আকাশে কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল সূর্য। মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল বিজ্ঞানীদেরও। এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলছিলেন, “২০০৯ সালে পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময় এ রকম হয়েছিল। সে বার পটনায় গিয়েছিলাম গ্রহণ দেখতে। মেঘে ঢেকে যাওয়ায় পুরো আয়োজনই মাটি হয়েছিল।”
যদিও ভাগ্য এ বার সদয়ই ছিল। সকাল সাড়ে ছ’টার পর থেকে উঁকি দিল সূর্য। গায়ে কালো ‘তিল’। সঙ্গে সঙ্গে অ্যালুমিনাইজড ফিল্টার গ্লাস দিয়ে আকাশমুখো হয়ে গেল খুদে ‘বিজ্ঞানী’রা। সেক্টর ফাইভের বাড়ির ছাদে এ দিন তাদের সঙ্গেই হাজির বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-পড়ুয়ারা থেকে প্রাতঃভ্রমণে বেরোনো সাধারণ মানুষ কিংবা অফিসযাত্রীরাও। |
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ছাত্রী রিয়া ভট্টাচার্য তাঁর বন্ধু রিমা চক্রবর্তীকে নিয়ে সকাল সাতটার মধ্যে চলে এসেছিলেন। রিয়ার কথায়, “জীবনে এই সুযোগ ফের মিলবে না।” এসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে চলে এলেন হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়। অফিস যাওয়ার পথে ঢুঁ মেরে গেলেন তথ্যপ্রযুক্তি-কর্মী সুপ্রতিম দাস। এত উৎসাহ? এক দর্শকের কথায়, “এই ঘটনা আবার ঘটবে ১০৫ বছর পর। না দেখলে আজীবন আফশোস থেকে যাবে।”
শুধু পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার নয়। ভোর থেকে প্রচুর মানুষ ভিড় করেছিলেন স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের শিবিরে। ভিড় জমেছিল বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম (বিআইটিএম), জগদীশ বসু ন্যাশনাল ট্যালেন্ট সার্চের ছাদ, এমনকী, কলেজ স্কোয়ার বা হাজরার হরিশ পার্কের পর্যবেক্ষণ শিবিরেও। বিআইটিএম কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ভোর সাড়ে পাঁচটাতেই শ’পাঁচেক লোক হাজির হয়েছিলেন। বেশির ভাগই স্কুল পড়ুয়া। সেখানে টেলিস্কোপে দেখানোর পাশাপাশি বিশেষ ‘অডিও-ভিস্যুয়াল শো’র ব্যবস্থা ছিল। আর্মি পাবলিক স্কুলের ছাত্র অমর্ত্যরাজ বসু পেন-ড্রাইভে করে গোটা অডিও-ভিস্যুয়াল ক্লিপিংসটি কপি করে এনেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মোটামুটি উপবৃত্তাকার পথে শুক্র অতিক্রম করেছে সূর্যকে। প্রথম ভোর পাঁচটা নাগাদ হালকা কমলা রঙের সূর্যের গায়ে শুক্রকে লক্ষ করা যায়। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ সূর্যের মধ্যভাগ পেরোয় সে। দশটার পর থেকে ধীরে ধীরে সূর্যের বাইরের দিকে যাওয়া শুরু করে। চাক্ষুষ করা গেল সরণের শেষে ‘ব্ল্যাক ড্রপ এফেক্ট’-ও (দেখলে মনে হবে, বিন্দুটিকে যেন টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে)। |
বঙ্গবাসীরা খুশি নিঃসন্দেহে। কিন্তু মুখ ভার কেরলের। সেখানে বর্ষা এসে যাওয়ায় মেঘে ঢাকা পড়ে গিয়েছে এই বিরল ঘটনা। দিল্লিতে নেহরু তারামণ্ডল, মৌসম ভবন-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেঘের দাপটে ভাল দেখা যায়নি।
সকাল ১০টা ২১ মিনিট। অতিক্রমণ সেরে আকাশে মিলিয়ে গেল শুক্র। কিছুটা যেন বিমর্ষই দেখাল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। কেন? পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন বললেন, “২০০০ থেকে ২০১২, এই শতকের প্রায় সব ক’টি বিরল মহাজাগতিক ঘটনা ঘটে গেল। অপ্রত্যাশিত কিছু না ঘটলে আর কোনও বড় ঘটনার পূর্বাভাস নেই।” |
ছবি: সুদীপ আচার্য, দীপাঞ্জন সাহা
|