আইপিএল চেটেপুটে উপভোগ করার দিন তিনেকের ভেতর এ দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা এ বার দাবায় টি-টোয়েন্টির মেজাজ আর স্বাদ পেতে চলেছেন। এবং সেটা আবার আইপিএলের মতো কোনও ঘরোয়া টুর্নামেন্ট নয়। একেবারে দাবার বিশ্ব খেতাবি লড়াই। আর সেখানে এক জন ভারতীয় দাবাড়ু বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জেতার হ্যাটট্রিক করার সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে। কী অসাধারণ মঞ্চ!
মস্কোয় সোমবার বিশ্বনাথন আনন্দ ১২ নম্বর তথা শেষ গেমটাও চ্যালেঞ্জার বরিস গেলফাঁর সঙ্গে ২২ চালে ড্র খেলে নেওয়ায় এক দিন বাদ দিয়ে বুধবার খেতাবি লড়াই র্যাপিড চেজ-এ ঢুকে পড়ল। আর র্যাপিড চেজ মানে অনেকটা ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টির মতো। আর সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, আমাদের আনন্দ প্রতিদ্বন্দ্বী গেলফাঁর চেয়ে অনেক-অনেক এগিয়ে।
আনন্দকে ছোটবেলায় দাবামহলে ডাকাই হত ‘লাইটনিং কিড’ বলে। এত দ্রুত চাল দিত। সেই অভ্যেসটাই ওর বরাবর থেকে গেছে। র্যাপিড দাবায় সফল হওয়ার যেটা সবচেয়ে বড় মন্ত্র। সেরা অস্ত্র। এক দিনই খেলা বলে বুধবারই জানা যাবে, ২০০৮-এ ক্র্যামনিক, ২০১০-এ টোপালভের পরে ২০১২-এ গেলফাঁকেও হারিয়ে আনন্দ তৃতীয় বার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জিতল কি না।
র্যাপিড দাবায় প্রথমে চারটে গেম হয়। ২৫ মিনিট করে সময় পায় এক-এক জন প্লেয়ার। এক-একটা চালের মাঝে ১০ সেকেন্ডের ফাঁক থাকে। যেটা সেই দাবাড়ুর সময়ের সঙ্গে যোগ হয়ে এক-একটা গেম সব মিলিয়ে শেষ হতে এক ঘণ্টা মতো লাগে। সেখানেও খেতাবি লড়াইয়ের মীমাংসা না হলে তার পরে শুরু হবে লাইটনিং দাবা। |
যেখানে ১০টা গেম খেলা হবে। প্রতিটা ৫ মিনিট করে। সেখানেও ম্যাচ ড্র থেকে গেলে সব শেষে সাডেনডেথ। ওই ৫ মিনিটেরই এক-একটা মিনি গেম। যে প্রথমে জিতবে সে-ই চ্যাম্পিয়ন। সোজা কথায় র্যাপিড দাবায় টি-টোয়েন্টির মতোই এক বার ছন্দ হারালে ম্যাচে ফেরত আসার সুযোগ খুব কম। প্রায় নেই বললেই চলে। টি-টোয়েন্টির মতোই চাপের সময় চিন্তাভাবনার সময় খুব কম। সব কিছু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।
আর এই সব ক’টা ব্যাপারেই গেলফাঁর চেয়ে আনন্দ আমার মতে অনেক এগিয়ে। হয়তো ওর বয়স হয়েছে। আগের মতো সেই দ্রুত ভাবার ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ‘স্পিড’ কমেছে। তবু দাবা-দুনিয়া যাকে র্যাপিড দাবার অবিসংবাদী প্লেয়ার মেনে নিয়েছে, কাসপারভ পর্যন্ত যাকে র্যাপিড চেজে সমীহ করে, সেই ভিশি বুধবার ওই ফর্ম্যাটে সফল হবে না এটা যেন ঠিক ভাবতে পারছি না।
সোমবার ক্ল্যাসিক্যাল দাবার (যেটা ৬ ঘণ্টা ধরে চলে। ২ ঘণ্টায় এক-এক জনকে ৪০ চাল দিতে হয়।) শেষ গেমেও যেন মনে হল আনন্দ বুধবারের কথা মাথায় রেখে খেলল। দু’বছর আগে এই শেষ গেমই কালো নিয়ে খেলেও আনন্দ টোপালভকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। হয়তো ওর এটাও মাথায় ছিল যে, সে দিন টোপালভ সাদা ঘুটিতে শেষ গেমে জেতার ঝুঁকি নিয়ে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছিল। তার জন্যও হয়তো আনন্দ এ দিন সতর্ক ছিল। যাতে জিততে গিয়ে খেসারত না দিতে হয়। খেতাবি লড়াইটাই না হারতে হয়।
পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, আগের দু’বারের চেয়ে এ বার আনন্দের বিশ্ব খেতাবি লড়াই যথেষ্ট ম্যাড়মেড়ে হয়েছে। সেই মনঃসংযোগ, সেই আক্রমণাত্মক স্টাইল, সেই ‘ক্লাস’ কোনওটাই আনন্দের খেলায় পেলাম না। তবু ১২ গেমের শেষে স্কোর ৬-৬ রেখে দিতে পারল কারণ, ওর বিপক্ষের খেলাতেও সে রকম কোনও নতুনত্ব, চমক বা ‘ক্লাস’ ছিল না। তবে আনন্দের খেলায় সেই পুরনো ঝলক না থাকার একটা কারণ হতে পারে যে, সম্প্রতি ও বাবা হয়েছে। যার জন্য এই প্রথম আনন্দের স্ত্রী অরুণা বিশ্ব খেতাবি লড়াইয়ে ওর পাশে নেই। বাচ্চাকে দেখার জন্য। বাড়ি-পরিবার, বাচ্চার থেকে বেশ কয়েক মাস দূরে থাকতে হওয়ায় হয়তো এই প্রথম আনন্দ ‘হোমসিকনেস’ বোধ করছে। যেটা ওর খেলায় ফুটে উঠছে।
তবে এ বার সব দাবাপ্রেমী তৈরি হন, বুধবার দাবার টি-টোয়েন্টি দেখার জন্য। যে ফর্ম্যাটে আনন্দের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ফলে এই মুহূর্তে বিশ্ব খেতাবি লড়াইয়ে অ্যাডভ্যান্টেজ আনন্দ! |