উৎসবের রাত? বিনোদনের রাত? ক্রিকেটের রাত? নাকি সিদ্ধির রাত?
কী ভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠা নাইটদের পরের প্রহরগুলোকে? বারবার রাত বলাটা বোধহয় ভুল হচ্ছে। রাত তো নয়, রাতভর। চেন্নাইয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সময় তাদের যে ঠিকানা, সেই তাজ করমণ্ডল হোটেলের বেসমেন্টে ছিল উৎসবের আয়োজন। প্রথম যখন ইউসুফ পাঠান ঢুকলেন, তখন রাত আড়াইটে। আর শেষ লোক যিনি প্রবেশ করলেন তিনি শাহরুখ খান। রাত তখন সাড়ে তিনটে। পার্টি কখন শেষ হল? সকাল সাড়ে সাতটায় শাহরুখ তাঁর ঘরে গেলেন। আক্রমরা কেউ কেউ তখনও রয়েছেন। ভারতীয় ক্রিকেটমহলের অনেকেই ছিলেন সেই পার্টিতে। কেউ মনেই করতে পারছেন না, ওয়াংখেড়েতে গত বছর ভারতের বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতা-উত্তর উচ্ছ্বাস বাদ দিলে এমন রাতভর ফূর্তি কখনও দেখা গেছে বলে। একটা ব্যাখ্যা দ্রুত উঠে এল। পাঁচ বছরে প্রচুর জমে থাকা হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস আর চাপা হতাশা লুকিয়ে ছিল নাইটদের অন্দরমহলে। ট্রফি জেতায় যেন তারই বিস্ফোরণ ঘটল।
অবিশ্বাস্য সব দৃশ্য। এক-এক সময় মনে হতে পারে, এটা বুঝি জীবন নয়, শাহরুখের ফিল্মের সেট। সেখানে বাস্তবকে চ্যালেঞ্জ করে পরপর ফ্রেমগুলো তৈরি হচ্ছে। ‘মেক বিলিভ’ পৃথিবী ছাড়া কী বলব? চেন্নাইকে হারিয়ে উঠে চেন্নাইয়েরই হোটেলে রাত্তির দু’টোর সময় যদি শ’পাঁচেক লোক নাচতে-গাইতে শুরু করে, তখন ফিল্ম সমালোচক তো তাকে অবাস্তবই বলতেন। টিমের জন্য বিশাল কেক তৈরি রেখেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। সেটা কেটে সবাই ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পরেও জনতা দাঁড়িয়ে, শাহরুখ কখন ঢুকবেন? হোটেলের দরজা থেকে লিফট অবধি চল্লিশ গজ রাস্তা তাঁকে চার জন ষণ্ডামার্কা বডিগার্ড আড়াল করে আনছিলেন। উচ্ছ্বাসের উৎপাত এমনই যে, শাহরুখকে যেন ভরদুপুরের হাজরা মোড়ে কেউ দেহরক্ষী ছাড়া ছেড়ে দিয়েছে। একেবারে অবাস্তব ফ্রেম। কিন্তু সত্যি। কিছু পরে ভরা বিনোদনের দুনিয়ায় চলে যাওয়া পার্টির মধ্যে শাহরুখ আনন্দবাজারকে বললেন, “এমসিএ-র কাছে মোটেই ক্ষমা চাইনি। ক্ষমা চেয়েছি শিশুদের কাছে। এমসিএ-র কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। বরঞ্চ রীতেশ দেশমুখকে মজা করে বলে এলাম, কী রে এখানে কী দেখে গেলি বাবাকে গিয়ে বলিস।” পার্টিতে শাহরুখকে ঘিরে তখন অসংখ্য নারীপুরুষ। শশী তারুরের স্ত্রী সুনন্দা পুষ্কর। আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল, রাইমা ও রিয়া সেন। চাঙ্কি পাণ্ডে। কলকাতা থেকে আসা অভিনেতা জিৎ। উষা উত্থুপ গান গাইছেন। ওই ছোট জায়গায় এত জোরে ক্যাকোফোনি হচ্ছে যে, কানের কাছে মুখ না গিয়ে গেলে কিছু শোনাই দুষ্কর। শাহরুখ তারই মধ্যে রাজ্যের যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে বললেন, “মমতাদির সঙ্গে মহাকরণে দেখা করতেই হবে। যখন আমি চাপে ছিলাম, তখনও উনি আমাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন।” আনন্দবাজার প্রতিনিধির দিকে আবার ঘুরলেন শাহরুখ। বললেন, “কলকাতা আমাকে অফুরন্ত ভালবাসা দিয়েছে। প্রতিদানে আমিও এই শহরকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। আজ ট্রফি জিতে পাওয়া মর্যাদা থেকে সেটাই হয়তো শুরু হল।”
এই বাঁধভাঙা আনন্দেও সিএসকে-কে নিয়ে তিক্ততা গেল না। তখনও চেন্নাই মালিকের অসুস্থতার খবর আসেনি নাইট শিবিরে। নানা অভিযোগের মধ্যেই কেউ কেউ বলছিলেন, ধোনিকে এ বার কী ভাবে ধমকাবেন শ্রীনিবাসন
শাহরুখকে দেখে মনে হচ্ছে, জীবনের সবচেয়ে বড় জুবিলি হিটের রাত। একটাই কাজ পারলেন না তাঁর অধিনায়ককে ডান্স ফ্লোরে তুলতে। শাহরুখ আর গম্ভীর পাশাপাশি। খুব আকর্ষণীয় পারস্পরিক শরীরী ভাষা। কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবে এক জন যদি ক্যাপুচিনো হন, অন্য জন তা হলে বরফ দেওয়া আমপোড়ার শরবত। নাচতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাই সারাক্ষণ ফ্লোরের ধারে দাঁড়িয়ে রইলেন। সেখানে তখন ভিড়ের মধ্যে নাচতে চলে গিয়েছেন শাহরুখ আর জুহি। আলো-আঁধারিতে কি অসাধারণ সব মুহূর্ত তখন তৈরি হচ্ছে, যা শো-তে পয়সা দিয়ে দেখার জন্য লোকে হামলে পড়ে। এলেন জয় মেটা, কিছুক্ষণ আগেই যিনি বলছিলেন, “ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ঠিকঠাক টেনে নেওয়ার জন্য আমাদের কিছু অপ্রিয় অথচ বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছিল। তখন সমালোচিত হয়েছিলাম। আজকের রাত হয়তো বোঝালো আমরা কেন, কী করেছিলাম?”
ডিজে তখন শাহরুখের হিট ছবিগুলোর গান এক-এক করে বাজাচ্ছেন। ‘ডন’ থেকে ‘খাইকে পান’, ‘দিল সে’ থেকে ‘ছাইয়া ছাইয়া’, ‘ওম শান্তি ওম’ থেকে ‘অল হট গার্লস পুট ইওর হ্যান্ডস আপ অ্যান্ড সে’। এক-এক সময় মনে হচ্ছে চিপকে এখনও খেলা চলছে। মোবাইলে দু’তিন জন অবিস্মরণীয় এ সব মুহূর্তের ছবি তুলতে গেলেন। দ্রুত আটকে দিলেন শাহরুখের দেহরক্ষীরা। বললেন, এগুলো ব্যক্তিগত মুহূর্ত।
মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার সঙ্গে শাহরুখের ভবিষ্যৎ নিয়ে এর ফাঁকেই আনাচে-কানাচে আলোচনা শুরু হল। রাজীব শুক্লকে কেউ কেউ বলছিলেন, শাহরুখকে নিষিদ্ধ করা কি সম্ভব? চ্যাম্পিয়ন টিম হয়তো তা হলে ওয়াংখেড়েতে খেলতেই গেল না। তা ছাড়া আইপিএলের সবচেয়ে বড় টিআরপি হলেন শাহরুখ। শুক্ল কিছু বললেন না, চুপ করে রইলেন। মনে হল, বক্তাদের সঙ্গে বিশেষ দ্বিমত নন।
আনন্দের উৎস টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ওঠা। কিন্তু আনন্দের প্রকাশ যেন ওয়ান ডে ম্যাচের মতো গোটা দিন ধরে চলবে। সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ একটা প্রভাতী দৈনিক এনে আক্রম বললেন, “এই দ্যাখো পেজ ওয়ানে কী রকম আমাদের গ্রুপ ফোটো দিয়েছে।” ব্রেট লি-সহ সামনের ভিড়টা তুমুল চিৎকার করে উঠল। আশ্চর্য লাগছিল, আক্রম বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়াও কত কত ট্রফি জিতেছেন। ব্রেট লিও তাই। তা হলে কী জাদু থাকছে একটা কুড়ি ওভারের টুর্নামেন্ট জয়ে যে এরা শিশুর মতো এমন উচ্ছ্বসিত?
মনোজ তিওয়ারি দেখালেন, নিরানব্বইটা মেসেজ এসেছে। একশো হলে উত্তর দেওয়া শুরু করবেন। শাহরুখের তো মেসেজ আর মেল এসেই চলেছে। সাকিব প্রচুর ফোন পেয়েছেন। সবাই বুঝছেন, নামেই কুড়ি ওভার। আইপিএল এখন এমন বৃহৎ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আকর্ষণ যে, তার জয়ের মশাল হাতে থাকা মানে ফুটবলবিশ্বে ম্যান ইউয়ের হয়ে ইপিএল জয়।
দিনের শেষে তাই হয়তো শাহরুখের সিদ্ধির রাত। সরি, মায়াবী রাতভর। |