ভদ্রলোকের ছেলে, তাই ক্রিকেট না খেলে ডাং-গুলি খেললে ভাবমূর্তির ক্ষতি,
মনে হয়েছিল এক নিতান্ত বালকের। লিখছেন
স্বাগত নন্দী |
অনেক ক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে; মাস্টারমশাই-দিদিমণি স্কুলের ভিতর দৈনন্দিন খাতাপত্রের কাজে ব্যস্ত। কাজকর্ম সেরে বেরিয়ে দেখেন তখনও বেশ কয়েক জন ছেলে স্কুলের হাতায়। ‘প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিন বিশেষ গা করিনি। কিন্তু দিনের পর দিন, ছেলেরা ছুটির পর বাড়ি যাচ্ছে না, এটা কেমন ব্যাপার?’ মাস্টারমশাই খোঁজ নিতে গিয়ে যে উত্তরটা পেলেন, তাতে হোঁচট খেলেন। ‘ঘর গেলেই তো প্রাইভেট মাস্টারের কাছে যেতে হবে। (মা-বাবা) খেলতে দেয় না যে। সেই জন্য ছুটির পর যত ক্ষণ পারি খেলে নিই।’
মাস্টারমশাই-দিদিমণি মা-বাবাদের একটা মিটিং ডাকলেন: কেন আপনারা বাচ্চাদের খেলতে দেন না? ‘ও সব আজেবাজে খেলা খেলে কী হবে?’ তাঁদের মতে ডাং-গুলি, ছু-কিত কিত হল আজে বাজে খেলা। ‘তা হলে ভাল খেলা কোনটা?’ ‘ক্রিকেট। কিন্তু সে তো এখানে খেলা হয় না। ও সব সরঞ্জাম কিনতে মেলা খরচা, আমরা পাব কোথায়?’
খেলা নিয়ে এই মূল্যায়ন এবং প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পাঠানো, এ দুটোর শিকড় একটাই: সমাজের উপরতলা থেকে নেমে এ শেকড় ক্রমাগত ঢুকে চলেছে আরও গভীরে।
একটি উচ্চবর্গজাত শহর-ঘেঁষা গ্রামের শিশুকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি কী খেল?’ উত্তর ‘ক্রিকেট!’ ‘ডাং-গুলি খেলো না?’ ‘আগে খেলাতাম, এখন খেলি না।’ ‘কেন?’ ‘ওতে আমার ইমেজ খারাপ হয়ে যায়।’ এই শিশুর ইমেজ-বোধ গড়ে সামাজিক স্তরবিন্যাস থেকে সেখানে ক্রিকেট হয়ে উঠেছে উচ্চবর্গীয় প্রতীক; আর ডাং-গুলি, ছু-কিত কিত সম্পর্কে ভদ্রলৌকিক যে নাক সিঁটকানি, সেটাই প্রভাবিত করছে নিম্নবর্গীয়দের মনোজগৎকেও। ‘ও-সব খেলায় ছেলেরা নষ্ট হয়ে যায়।’ আর ক্রিকেটটা ভদ্রলোকের খেলা। সেটা খেলার সামর্থ্য যদি না থাকে, তা হলে কোনও খেলাই খেলার দরকার নেই ভদ্রলোক যদি না-ও হতে পারে, ছেলেরা অন্তত নষ্ট যেন না হয়।
নষ্ট না হতে হলে লেখাপড়া করতে হবে। এ বার সেই লেখাপড়া শুধু স্কুলের চৌহদ্দিতে সম্পূর্ণ হবে না। কেন হবে না, প্রশ্নের উত্তরটা বেশ প্যাঁচালো। এক দিকে আছে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার নানা সমস্যা, যার আবার নানা শাখা-প্রশাখা। পরিকাঠামোগত অভাব যেমন একটা বাধা, তেমনই আবার আছে শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে ‘প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া’-সহ সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ‘ওরা পারে না, ওদের দিয়ে হবে না; বাড়িতে পড়ার পরিবেশ নেই, পড়ানোর লোক নেই, ইত্যাদি।’ অন্য দিকে, সমাজের উপরতলা থেকে নেমে আসে প্রতিযোগিতামুখী এক সর্ব-আচ্ছন্নকারী প্রাইভেট টিউশনের ছায়া। আমরা এমন বহু স্কুল দেখেছি, যেখানে স্কুল যথেষ্ট ভাল চলা সত্ত্বেও এবং মা-বাবারা সেটা স্বীকার করলেও, মনে করছেন, প্রাইভেটে গেলে আরও ভাল ফল করবে। এ সমস্যার আর এক শাখা হল, আমাদের পাঠক্রমের বোঝা, যাতে খুব চেষ্টা করেও লেখাপড়ার কাজটা স্কুলের মধ্যে শেষ করা কঠিন।
এই প্রতিযোগিতার মনোভাব, শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি মা-বাবাদের বিপুল আগ্রহ, সকলেই মানবেন, এটা খুবই ইতিবাচক জিনিস। এবং মা-বাবারা শুধু শিক্ষা নয়, গুণগত মানের শিক্ষা চাইছেন, এটা নিশ্চয়ই একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু, এই বিপুল প্রতিযোগিতায় শিশুর জায়গা কোথায়? তার ‘ইমেজ’ গড়ে দেওয়ার এই বিরাট কারখানায় তার শৈশব, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, তার ছোট্ট প্রাণের ধুকপুকুনি কি আমরা শুনি?
ওরা অবোধ, ভাল-মন্দ বোঝে না, তাই আমাদেরই ঠিক করে দিতে হবে তারা কী করবে না-করবে? সত্যিই কি তারা অবোধ? কত ধানে কত চাল হয় সেটা হয়তো তারা বোঝে না, বোঝে না ক্রীড়া বাজারের নিপুণ কৌশলে কী ভাবে গড়ে ওঠে বিশেষ খেলার বিশেষ কৌলীন্য। কিন্তু, সহমর্মিতার চোখ দিয়ে দেখলে তাদের ভেতর দেখা যায় বোধের সমাহার সে বোধে কখনও তারা হারিয়ে যায় নিজস্ব কল্পনার জগতে জলভরা মেঘ, ডানা-মেলা পাখি বা ঝোড়ো হাওয়ায় আবার কখনও হাত বাড়িয়ে দেয় মাটিতে পড়ে যাওয়া সহপাঠীকে তুলে নিতে।
ওরা নাকি পড়তে চায় না! অনেকের কাছে সেটাই তাদের প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পাঠানোর একটা কারণ। সত্যিই কি তারা পড়তে চায় না? প্রতীচী ট্রাস্ট ও ক্রাই-এর যৌথ উদ্যোগে বীরভূম জেলার কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের নিয়ে আমরা বেশ কয়েকটি পাঠ উৎসব করছি। এক-একটা উৎসব শেষ হচ্ছে, আর আমরা যেন পুনরায় খুঁজে পাচ্ছি নিজেদের শৈশব সেই উৎসবে আত্মহারা শিশুদের অপূর্ব অংশগ্রহণে। একটা গোটা দিন বই পড়ে, গান গেয়ে, ছবি এঁকে, নেচে এবং সর্বশেষে ভাঙাচোরা বানান ও ভাষায় নিজের অভিজ্ঞতা লিখে যখন বাড়ি ফেরার সময় হয়, তখন তাদের মন খারাপ। আমাদের থাকা হয় না। ওদেরও ফিরে যেতে হয়, হয়তো বা প্রাইভেট মাস্টারের কাছে। কিন্তু, ওই একটা দিনে তারা আমাদের বোধে রেখে যায় এক উজ্জ্বল উদয়: ওরা পড়তে চায়, শিখতে চায়। কিন্তু, সেই সঙ্গে চায় একটু নিজের জায়গা। এটা গ্রামের সাধারণ স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য যতটা সত্য, ততটাই সত্য সেই সব উচ্চবর্গজাত শিশুদের জন্যও, যাদের ঠেসে পুরে দেওয়া হয় এক কলে, যেখান থেকে সে ‘উৎপন্ন’ হয়ে উঠবে মূর্তিমান সাফল্য হিসেবে এক জনই সব উৎকর্ষ অর্জন করে নেবে। আর এই চুঁইয়ে পড়া সাফল্যের বা সাফল্য কামনার জন্য গড়ে উঠবে একটাই ছাঁচ যেখানে শিশুর খেলতে মানা, হাসতে মানা, স্বপ্ন দেখাও মানা। সন্তানের শিক্ষালাভের জন্য জরুরি আগ্রহকে স্বাগত জানাতে গিয়ে আমরা যদি শিশুদের উপর নিষেধাজ্ঞা ও আদেশের এই ক্রমপুষ্ট সংস্কৃতির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখি, সেটা আমাদের কোন সমাজ দেবে, তা না ভাবলে চলে না।
|
প্রতীচী ট্রাস্টে কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত। |