ভর দুপুরে এক ঘণ্টারও কম ব্যবধানে খুন হলেন তৃণমূলের তিন নেতা-কর্মী।
প্রথম খুনটি হয় বীরভূমের দুবরাজপুর শহরে সোমবার দুপুর ২টো নাগাদ। গুলি করা হয় তৃণমূল নেতা গোলাম সাব্বির কাদেরিকে (৪০)। মিনিট চল্লিশের মধ্যেই দুবরাজপুর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে গুলি করে মারা হয় তৃণমূল নেতা আনিসুর রহমান (৩৫) এবং দলীয় কর্মী সুখেন্দু সরকারকে (৪৫)।
গোলাম কাদেরি ও সুখেন্দুর বাড়ি কাঁকরতলার বড়রা গ্রামে। পেশায় প্রাথমিক-শিক্ষক আনিসুর স্থানীয় কদমডাঙা গ্রামের বাসিন্দা। সুখেন্দু ও আনিসুর অকৃতদার। গোলামের স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। কেন এই তিন খুন, কে বা কারা খুনের পিছনে তা নিয়ে পুলিশ মুখ খোলেনি। বীরভূমের পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনা শুধু বলেছেন, “তদন্ত চলছে।” রাত পর্যন্ত কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি। কেউ ধরাও পড়েনি।
তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের একাংশ কিন্তু এই ঘটনার পিছনে দলীয় ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছায়া’ দেখতে পেয়েছেন। পাশাপাশি, খুনের পিছনে অবৈধ কয়লা কারবার নিয়ে বিরোধের সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। পুলিশ সূত্রের দাবি, নিহত গোলাম কাদেরি অবৈধ কয়লার কারবারি হিসেবেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁকে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের গোষ্ঠীর লোক বলেই সকলে জানতেন। অন্য দুই নিহত নেতা-কর্মী বিপক্ষ গোষ্ঠীর অনুগামী। |
কী হয়েছিল এ দিন?
পুলিশ সূত্রের খবর, একটি গাড়িতে এলাকার এক দাপুটে তৃণমূল নেতা অশোক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ দিন দুপুরে দুবরাজপুর শহরে যান গোলাম কাদেরি। দুপুর ২টো নাগাদ সাতকেঁদুরি এলাকায় রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম জাতীয় সড়কের ধারে ঠান্ডা পানীয় কিনতে একটি হোটেলে যান ওই দু’জন। অশোকবাবু বলেন, “আমি সবে হোটেলে ঢুকেছি। তখনই গুলির শব্দ। ছুটে বেরিয়ে দেখি, গোলাম রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে। ওর বাঁ কানে গুলি করা হয়েছে। আর মুখে কাপড় বাঁধা দুই মোটরবাইক আরোহী দুবরাজপুরের দিকে তীব্র গতিতে পালাল।”
কিছু ক্ষণ পরেই দুবরাজপুর শহর থেকে কিলোমিটার দশেক দূরে খয়রাশোলের কেনান গ্রামের কাছে একটি কালভার্টের পাশে জমা জলে একটি লাল রঙের মোটরবাইক এবং তার পাশে একটি দেহ পড়ে থাকার খবর পায় পুলিশ। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দেহটি সুখেন্দু সরকারের। মাথার পিছনে গুলির ক্ষত। তল্লাশিতে একটি দূরেই মেলে লাল রঙের হেলমেট, একজোড়া জুতো। রাস্তার পাশের মাঠে পাওয়া যায় আনিসুর রহমানের আধশোয়া দেহ। তাঁর ডান কানে গুলির চিহ্ন। হাত পিছমোড়া।
খয়রাশোলে তৃণমূলের ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ অনেক দিনের। প্রাক্তন ব্লক সভাপতি অশোক ঘোষ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের গোষ্ঠীর মধ্যে একাধিকবার মারামারি হয়েছে। অশোক ঘোষের অভিযোগ, “প্রথমে সিপিএম, পরে অশোক মুখোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে থেকে গোলাম রমরমিয়ে অবৈধ কয়লার কারবার চালিয়েছে। আনিসুর আর সুখেন্দু গোলামের অবৈধ ব্যবসার প্রতিবাদ করতেন বলেই তাঁদের খুন করা হয়েছে।” কিন্তু গোলামকে কারা, কেন খুন করল, সে বিষয়ে মন্তব্য করেননি অশোক ঘোষ। অশোক মুখোপাধ্যায় গোলামকে ‘মদত’ দেওয়ার অভিযোগ মানেননি।
জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রতবাবুর বক্তব্য, “অবৈধ কয়লা কারবার নিয়ে বিরোধের জেরে তৃণমূলেরই পতাকাধারী কিছু লোক আমাদের দলের নেতা গোলামকে খুন করেছে। কিন্তু আনিসুর ও সুখেন্দু কেন খুন হলেন, বলতে পারব না।” তাঁর সংযোজন, “গোলাম বছর দু’য়েক আগে কয়লার ব্যবসা করতেন। বর্তমানে তিনি ও-সব কারবারে ছিলেন না। বরং খয়রাশোল ও কাঁকরতলায় দলীয় সংগঠন মজবুত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।”
এলাকাবাসীর একাংশ অবশ্য দাবি করেছেন, খয়রাশোলে একটি বেসরকারি কয়লা সংস্থার খোলামুখ খনি এবং বর্ধমান ও ঝাড়খণ্ড থেকে পাচার হয়ে আসা কয়লার বখরাকে কেন্দ্র করেই মূলত তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বিবাদ। তৃণমূলেরই সূত্রে জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি এলাকার বড়রা পঞ্চায়েতের দখল সিপিএমের হাত থেকে তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর (অশোক মুখোপাধ্যায়-গোলাম কাদেরি) হাতে আসে। ফলে, ওই এলাকায় এক সময় ‘দাপট’ থাকা স্থানীয় বাবুইজোড় পঞ্চায়েতের সদস্য (কংগ্রেসের টিকিটে জিতে তৃণমূলে যোগ দেওয়া) আনিসুরের প্রভাব কিছুটা কমে যায়। তা নিয়েও দুই গোষ্ঠীর সংঘাত হচ্ছিল।
তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে দুই গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে বসে মীমাংসাসূত্র বার করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এ দিন দুবরাজপুরের কোথাও একটি দুই গোষ্ঠীর বৈঠক হওয়ারও কথা ছিল। তার আগেই এই কাণ্ড ঘটে গেল!” |