এক বছর আগের সময়টাই যেন ফিরে এসেছে। তীব্র গরম। মাথায় টুপি। চোখে রোদচশমা। নলহাটির দোরে দোরে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।
গত বছরও এই রুটিন ছিল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছেলে, নলহাটির কংগ্রেস বিধায়ক অভিজিতের। ২০১২-র মে মাসে, নলহাটি পুরসভা নির্বাচনের মুখেও তাঁর রুটিন এক। স্বামীর হয়ে ফের প্রচারে স্ত্রী চিত্রলেখা। তবে এক বছরে বদলে গিয়েছে নলহাটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। বদলেছে কংগ্রেস-তৃণমূল সমীকরণ। বিধানসভা ভোটে জেতার এক বছরের মাথায় তাই আবার ‘কঠিন পরীক্ষা’-র সামনে ‘স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’র প্রাক্তন কর্তা অভিজিৎবাবু। পরীক্ষাটা ‘কঠিন’, কারণ নলহাটি পুরভোটে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী একযোগে বাম-শিবির ও প্রধান শাসকদল তৃণমূল। পুরসভার ১৫টি ওয়ার্ডেই সরকারি দুই জোট শরিকের প্রার্থী থাকায় ‘ভোট ভাগাভাগির’ সম্ভাবনা প্রবল। যে ‘ঘোলা জলে’ দাঁড়িয়ে প্রথম বার নলহাটি পুরসভায় ক্ষমতায় আসার ক্ষীণ আশায় বামফ্রন্টও। যদিও সিপিএমের বীরভূম জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি (যেটা লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রেও সিপিএমের নেতারা বলে থাকেন), “ওদের জোট হল কি হল না, তা আমাদের মাথাব্যথা নয়। আমরা দুই শক্তির বিরুদ্ধেই লড়ছি।”
অথচ, এক বছর আগে নলহাটিতে অভিজিৎবাবুর হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন এলাকার তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। সেই ‘সন্ধি’ একবছর পরের পুরভোটের মুখে ভেঙে চুরমার। সকাল-বিকেল পরস্পরকে ‘গালমন্দ’ করছে কংগ্রেস-তৃণমূল। দু’শিবিরে তিক্ততা এতটাই যে, নলহাটিতে সম্প্রতি হওয়া রেলের ‘রোড ওভারব্রিজ’-এর শিলান্যাস অনুষ্ঠানে ডাকও পাননি স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক! |
অভিজিৎবাবু অবশ্য বলছেন, “আমি জোটেরই বিধায়ক। পুরভোটে জোট না হওয়ায় খারাপ লাগছে।” ঘটনাও হল, প্রচারে বেরিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কুৎসার পথে হাঁটছেন না প্রণব-পুত্র। তবে ভোট কাটাকাটির সুবিধা বামফ্রন্ট পেতে পারে বলে তাঁরও আশঙ্কা রয়েছে। অভিজিৎবাবু সরাসরি না-বললেও তৃণমূলকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিচ্ছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। যার কারণ হিসেবে তাঁদের বক্তব্য, কংগ্রেসের টিকিটে জিতেও ২০০৯ সালের নভেম্বরে তৃণমূলে যোগ দেন নলহাটির বর্তমান পুরপ্রধান বিপ্লব ওঝা-সহ ৮ কংগ্রেস কাউন্সিলর। রাতারাতি পুরসভার ক্ষমতা চলে যায় তৃণমূলের হাতে।
বস্তুত, তখন থেকেই নলহাটিতে দু’দলের ‘তিক্ততা’র সূত্রপাত। যা বিধানসভা ভোটের আগে জোটের স্বার্থে কিছুটা মিটলেও পুরভোটের মুখে ফের ‘প্রকাশ্যে’ এসে পড়েছে।
ভোট-তথ্য বলছে, ২০০২ সালে পুরসভা হিসাবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই সেখানে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস (২০০৯-এর ঘটনার আগে পর্যন্ত)। এমনকী, ২০০৭ সালের পুরভোটেও সব ক’টি ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী দেওয়া সত্ত্বেও ১১টি ওয়ার্ড পেয়েছিল কংগ্রেস। আসন জেতা তো দূর অস্ত, তৃণমূল প্রার্থীরা ১৬টি ওয়ার্ড মিলিয়ে (সীমানা পুনর্বিন্যাসের জন্য এ বার অবশ্য একটি ওয়ার্ড কম) ৫০০ ভোটেরও কম পেয়েছিলেন। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে ওয়ার্ড-ভিত্তিক ফল অনুযায়ী একটি ছাড়া প্রতিটিতেই এগিয়ে ছিলেন জোট-প্রার্থী অভিজিৎবাবু। কিন্তু, ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের ফলাফল আবার বলছে, জোট না হলে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে অভিজিৎবাবু পিছিয়ে থাকতেন।
সে দিক থেকে দেখতে গেলে এই প্রথম একক ভাবে নলহাটি পুরসভায় পরীক্ষার সামনে তৃণমূলও। আরও বড় পরীক্ষা কংগ্রেস-ত্যাগী পুরপ্রধান বিপ্লব ওঝার। যাঁর বক্তব্য, “কংগ্রেস আমাদের বিশ্বাসঘাতক বলছে কোন যুক্তিতে? আমাদেরই সাহায্য নিয়ে ওদের প্রার্থী বিধানসভায় জিতেছেন। এখন আমাদের নামেই দিনরাত কুৎসা করছেন অনেক কংগ্রেস নেতা। বরং ওরাই দ্বিচারিতা করছে!” তবে কংগ্রেসের টিকিটে জিতে তৃণমূলে যোগ দেওয়া এবং এ বার তৃণমূলের হয়ে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়ায় যে বিস্তর পার্থক্য, আড়ালে তা মানছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারাও। দলের এক জেলা নেতার কথায়, “লড়াই কঠিন। তবে এটাও ঠিক, ২০০৭-এর সঙ্গে এ বার জমিন-আসমান ফারাক। লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের পর তৃণমূলই রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দল।”
তা সম্যক জানেন অভিজিৎবাবুও। মুখে না মানলেও এই ভোট তাঁর কাছে এক অর্থে ‘মর্যাদার লড়াই’! সাধে কি আর এক বছরের মধ্যেই ফের দোরে দোরে গিয়ে তাঁকে আবার বলতে হচ্ছে, ‘‘আমি তোমাদেরই লোক!’’ |