গম্ভীর্স বল্লেবাজি!
বালাজি’স ক্যাচ অফ দ্য ডে!
তিওয়ারি’স ইন্টারন্যাশনাল ইনিংস!
দ্য কালিস হ্যাটট্রিক!
রবিবার চেন্নাইয়ের ফাইনালের জন্য নাইটদের নামের পাশে লিখে দেওয়া কোনও মনোবিদের টোটকা নয়। বরং শহরে নাইটদের আইপিএল ডেরায় টাঙিয়ে দেওয়া বিশেষ ‘মেনু কার্ড’।
বাইপাসের ধারে পাঁচতারা হোটেলে যা এখন পাওয়া যাচ্ছে। গত দু’মাস ধরে এটাই গৌতম গম্ভীরদের ডেরা। ‘হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম’। গম্ভীরের প্রিয় খাদ্য যেমন পিন্ডি ছোলে কুলচা। সেই মেনুর ওপরে লেখা থাকছে ‘গম্ভীর্স বল্লেবাজি’। ব্রেট লি-র তেমনই চিকেন বার্গার। মেনুতে তার ওপরে লেখা থাকছে ‘লি অন দ্য গো’। রবিবার মধ্যরাত পর্যন্ত ‘কেকেআর স্পেশ্যাল মেনু’ চালু থাকছে। মানে রেস্তোরাঁয় বসে ‘স্পেশ্যাল নাইট মেনু’ সহকারে নাইটদের কাপ-ভাগ্য দেখে নাও।
শনিবার শহর কলকাতা চক্কর দিতে গিয়েও মনে হচ্ছে, চুম্বকে এটাই শহরের মেজাজ। টি-টোয়েন্টি সংস্কৃতির পক্ষে যা দারুণ মানানসই। খাও, পিও, কাপ জেতা দ্যাখো রে!
ধোনির চেন্নাই সুপার কিংসকে ইডেনে লিগ ম্যাচে হারিয়েছিলেন গম্ভীররা। তার পরের দিনই শহর ছেড়ে তাঁরা বেরিয়ে যান কাপের অভিযানে। হোটেল কর্তৃপক্ষ বিদায়ী শুভেচ্ছা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। ‘টোয়েন্টি-ওয়ান ব্যাট স্যালুট’ দেওয়া হয় নাইটদের। পড়ে শোনানো হয় নানা ‘গুডউইল মেসেজ’। সে সব দেখে ক্রিকেটারেরাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ বলে ফেলেন, “এই ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারব যদি কাপ নিয়ে ফিরতে পারি।”
রবিবার সেই মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে শেষ স্টেশন জয়ের সামনে গম্ভীররা। যা নিয়ে উৎসাহ আর আবেগের অভাব নেই। রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের উদ্যোগে জায়ান্ট স্ক্রিন বসছে ইডেনের সামনে। আবার আশঙ্কার ঢেউও মাঝেমধ্যে আছড়ে পড়ছে। সল্ট লেক সিটি সেন্টারে জায়ান্ট স্ক্রিনে ফাইনাল দেখা যাবে কি না সেই খোঁজ করার ফাঁকে এক নাইটভক্ত যেমন বলে ফেললেন, “ধোনি ফাইনাল হারে না, এটাই খুব চিন্তায় রাখছে। তার ওপর মুম্বই আর দিল্লি দু’টো ভাল টিমকে পরপর হারিয়ে চেন্নাই ফাইনালে উঠেছে।”
|
শহরে কারও কারও জন্য আবার কাপ উঠল কি উঠল না তা দিয়েই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাচ্ছে না। জগমোহন ডালমিয়া যেমন। রবিবার গম্ভীররা ট্রফির জন্য লড়বেন মাঠের মধ্যে। আর মাঠের বাইরে তাঁর এত কালের সমস্ত প্রশাসনিক দক্ষতা আর অভিজ্ঞতাকে এক করে ডালমিয়া তৈরি হচ্ছেন পরের বারের ফাইনাল কী করে ইডেনে নিয়ে আসা যায় সেই লড়াইয়ের জন্য। সিএবি প্রেসিডেন্ট যে আস্থাভাজন সতীর্থদের নিয়ে চেন্নাইয়ের ফাইনাল দেখতে গেলেন, তার পিছনে এটা একটা বড় কারণ।
কেকেআর জিতলে তো আইপিএলের নিয়ম অনুযায়ী পরের বারের ফাইনাল ইডেনে চলে আসবে। যদি চেন্নাই জেতে তা হলে আগামী বারও ফাইনাল হওয়ার কথা চেন্নাইয়ে। ডালমিয়া এটা নিয়েই লড়াই করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলতে চান, এ বার নিয়ে পরপর দু’বার তো ফাইনাল পেয়েই গেল চেন্নাই। আবার তৃতীয় বার কেন? কেন ফাইনাল খেলার পরেও ২০১৩-র ফাইনাল ইডেন পাবে না? আইপিএলের নিয়মের কথা উঠলে তিনি পাল্টা সওয়াল করতে চান এই বলে যে, চ্যাম্পিয়ন টিম পরের বারের ফাইনাল পাবে, সব সময় এই নিয়ম মানা হয়নি। মুম্বই দু’বার ফাইনাল পেয়েছে। উদ্বোধনী বছর ২০০৮-এ। এবং ২০১০-এ। অথচ মুম্বই ইন্ডিয়ান্স এক বারও আইপিএল জেতেনি।
একটা সময় ছিল, ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যখন ছিলেন, তখন প্রচুর ম্যাচ নিজের ক্ষমতাবলে চেন্নাই বা মোহালি থেকে ইডেনে নিয়ে এসেছেন ডালমিয়া। এখন বোর্ড চালান চেন্নাইয়ের শ্রীনিবাসন। ধরেই রাখা যায় মাঠের মধ্যে চেন্নাই বনাম কলকাতার ক্রিকেটীয় লড়াইয়ের মতোই উত্তেজক হতে যাচ্ছে মাঠের বাইরে দুই শহরের প্রশাসনিক লড়াই। ডালমিয়া এবং তাঁর টিমের মনোভাব দেখে মনে হবে, তাঁদের স্লোগান হচ্ছে কাপ ফস্কালেও কাপ ফাইনাল আনব রে!
শহরের মেজাজ দেখে আবার মনে হচ্ছে, তিন জন তারকা জড়িয়ে যাচ্ছেন রবিবারের ফাইনাল ঘিরে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কলকাতার জামাই। রবিবারের ম্যাচে চেন্নাইয়ের অধিনায়ক। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এ বারের আইপিএলে কার্যত বঙ্গভঙ্গ করে দিয়েছিলেন পুণে ওয়ারিয়র্স এবং কেকেআরের মধ্যে। গৌতম গম্ভীর একমাত্র তাঁরই কলকাতার সঙ্গে কোনও অতীত সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে আবেগের সম্পর্ক সম্ভবত তৈরি হয়ে গেল আইপিএল ঘিরে। দিল্লির বাসিন্দা হয়েও আজ তিনি কলকাতার বন্দিত অধিনায়ক। ধোনির শ্বশুরবাড়ির পাড়া আলিপুর থেকে শুরু করে সৌরভের বেহালা সর্বত্র দারুণ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে ফেলেছেন। সৌরভের পাড়ায় বসে যাঁরা ‘দাদা’র পাশে দাঁড়ানোর কথা শোনালেন শনিবার সন্ধ্যায়, তাঁদের মুখেও গম্ভীর নিয়ে কোনও বিরূপ মন্তব্য নেই। দাদা’র পুণে ছিটকে গিয়ে এখন সমর্থনের কাজটাও অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। “কেকেআর ভাল খেলছে। জিতলে তো ভালই হয়,” বলে দিচ্ছেন তাঁরা। ঢিল ছোড়া দূরত্বে বীরেন রায় রোডের বাড়িতে বসে সৌরভ তখন টিভি-তে বলছেন, “আমি চাই নতুন চ্যাম্পিয়ন আসুক!”
সৌরভ আন্তর্জাতিক সফর থেকে সফল হয়ে ফেরার পর এখানে বহু সংবর্ধনা হয়েছে। ২ এপ্রিল, ২০১১ ধোনি বিশ্বকাপ জেতার দিন এখানে রাস্তার মুখে বড় করে গেট বানানো হয়েছিল। ২৭ মে, ২০১২-র রাতে একই জায়গায় গম্ভীরের নামে জয়ধ্বনি উঠবে? বাজি ফাটবে? এক জন জবাব দিলেন, “দেখুন, এখানে দাদাকে নিয়ে একটা ব্যাপার তো আছেই। সেটা চিরকাল থাকবে। তবে আমাদের মধ্যেও কেকেআরের ফ্যান আছে। কেকেআর জিতলে তারা নিশ্চয়ই উৎসব করবে।”
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, আইপিএল এবং কেকেআর-এর হাত ধরে কি নতুন দিগন্তই খুলে গেল কলকাতার সামনে? এ শহর ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা নিয়ে চেঁচিয়েছে। মারাদোনা, রোনাল্ডো, জিদানদের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছে। সৌরভের জন্য চেঁচিয়েছে। ‘স্যাচিন স্যাচিন’ গর্জন করেছে। ভারতীয় ক্রিকেটের জয়ে উৎসব করেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! কলকাতার জন্যই যে আজ পর্যন্ত চেঁচানো হয়নি কলকাতার!
২৭ মে, ২০১২ কি তা হলে চেন্নাইয়ে শুধুই ফাইনালের শেষ যুদ্ধ? নাকি নতুন যাত্রাপথেরও শুরু? |