ফ্রিজ-এসি তো নেই-ই। সময়ে সময়ে আলোও উধাও। তা-ও কিন্তু
ভাত-তরকারিরা নষ্ট হত না,
তেষ্টা মেটাতে পাওয়া যেত হিমঠান্ডা জল।
মনে মনে সেই সাদাকালো গ্রীষ্মদিনে ঘুরে এলেন বিশ্বজিৎ রায় |
বেজায় গরম। কিন্তু তিব্বত যাওয়ার উপায় নেই। আর যেখানে যেখানে গেলে কিছু ঠাণ্ডা হওয়া যেতে পারে, সেখানকার ট্রেনের টিকিট হাওয়া, থাকার জায়গায় নো ভেকেন্সি। কাজেই ফ্রিজ-কবলিত, এসি-বাহিত পোড়া বঙ্গে ঘেমো অঙ্গে বসে বসে যেতে হল সেখানে, যেখানে সহজে যাওয়া যায়। মনে মনে হাজির হলাম ফ্রিজবিহীন বৈশাখী দিনে। ফ্রিজ-এসি-বাঙালি কত দিনের! তার আগে অধিকাংশ বাঙালি কী ভাবে যাপন করতেন গ্রীষ্ম! কোন টেকনিকে লু বওয়া, ঘাম মাখা দিন-দুপুর, রাত-বিরেত কাটাতেন তাঁরা সেই নাতিপুরাতন সাদাকালো টুকিটাকি।
গরম পড়তে না পড়তে জালাওয়ালা আর কুঁজোওয়ালা হাজির। ইস্কুলে জালা, বাড়িতে কুঁজো। বাংলা মিডিয়ম ইস্কুলের পিরিয়ডের ঘণ্টাদাদার গরমকালে একটা কাজ ছিল অতিরিক্ত, কিন্তু আবশ্যিক। স্কুল বসার আগে নতুন জালায় জলভরা হয়েছে কি না, তা দেখা। সেই জালার বসবাস টায়ার আর বালির ওপর। একটা গোল টায়ার ব্যবহার করা হত বিড়ে হিসেবে আর টায়ারের ফাঁকে রাখা থাকত পরিষ্কার বালি। সেই বালি ভেজানো হত ঘণ্টায় ঘণ্টায়। ভেজা বালির ছোঁয়ায় ঠাণ্ডা থাকত নতুন জালা আর জালার ভেতরের জল। টিফিনে জালার সামনে লম্বা লাইন। ক্লাসের মাঝেও জল খাওয়ার ছুটি মিলত। গরমে কে সি নাগের বই থেকে সরল কষানো কঠিন গোবিন্দবাবুও ধুতি-পাঞ্জাবিতে খানিক ঢিলেঢালা। যে ইস্কুলের হেডমাস্টার যত ভাল, সে ইস্কুলের জালার জল নাকি তত ঠাণ্ডা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জালার বালি ভেজানো হচ্ছে কি না, সেটা দেখাই গরমকালে হেডস্যারের একমাত্র কাজ। বাড়িতে জালা নয়, শোওয়ার ঘরের কোণায় এসে বসত কুঁজো। তবে ঘরের চার কোণের কোনটি তার জন্য উপযুক্ত হবে আর নতুন কুঁজো ফুটো কি না এই দুই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ ছিল না। কুঁজোওয়ালা অর্ধেক দামে কুঁজো দিয়ে যেত। |
এক দিন, এক রাত সেই নতুন কুঁজোয় জল ভরে ফেলে রাখা হত। ফুটো নয়, এটা হাতে হাতে প্রমাণিত হলে তবে কুঁজোওয়ালা বাকি পয়সা পেত। তার পর ঠিক করতে হত, ঘরের কোথায় থাকবে সেই সবেধন নীলমণি। মধ্যবিত্তের ঘরের কোণ কখনও সমান হত না। কুঁজো রাখতে গেলেই সে ঝুঁকে পড়ত। কাজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বাজিয়ে ঠিক করতে হত কোথায় থাকলে সে ঝুঁকে পড়বে না, চলন পথে পায়ের মুখোমুখি হবে না, কিছুটা বাইরের লোকের চোখের আবডালে থাকবে। ভাড়াবাড়িতে মধ্যবিত্তের বসার ঘর থাকত না। তেমন প্রতিবেশীরা এলে শোওয়ার ঘরেই বসত। নতুন কুঁজো দেখতে পেলেই তাদের তেষ্টা পাক, বা না পাক, জল খেতে সাধ হত। বাড়ির কাজের দিদি দিনে দু’বার কুঁজো ভরতে চাইত না। তা ছাড়া সকালে জল ভরলে তবে তো দুপুরে কুঁজোর জল হিমঠাণ্ডা হবে। কাজেই কুঁজো রাখার কোণাটা হতে হবে ঢেউ না খেলানো, চলন পথের বাইরে আর ঘরে ঢুকে পড়া প্রতিবেশীর চোখের আবডালে।
কিন্তু শুধু তো ঠাণ্ডা জল খেয়ে পেট ভরবে না। গরমে ঘুঁটে কয়লার উনুনে গনগনে আঁচে দু’বেলা রান্না করতেও মায়েদের ভাল লাগত না। আর বিকেলে চৌবাচ্চার জমা ঠাণ্ডা জলে গা ধোয়ার পর কারই বা হাঁড়ি-হেঁশেল ঠেলতে ভাল লাগে! এ দিকে সকালের রান্না গরমে রাত অবধি থাকতে চায় না! তা হলে উপায়? কী ভাবে সকালের রান্না গরমে না-নষ্ট করে রাত অবধি রাখা যায়, তা ছিল গরমকালের বড় প্রশ্ন। জবাবটা জটিল, তবে অসম্ভব নয়। সকালের ভাতের হাঁড়িতে একটু দুপুর বিকেল ঘেঁষে জল ঢেলে দিলেই গোল চুকত। তা ছাড়া গরমে কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা আর পোস্তবাটা দিয়ে পান্তাভাত দিব্যি লাগে। সমস্যা সকালের ডাল, তরকারি আর মাছ নিয়ে। বাইরে খোলা ফেলে রাখলে ডাল, তরকারি, মাছের শরীরে খানিকটা হাওয়া লাগবে, কিন্তু বেড়ালে মুখ দেবে, পিঁপড়েরা সারি বাঁধবে। পিঁপড়েদের ঠেকানো তুলনায় সোজা। কলাইয়ের একটা চেটালো কিন্তু গভীর থালায় জল রাখতে হবে। সেই জলের ওপর বসাতে হবে বাটি। সেই বাটির ওপর ঢাকা দিয়ে আর একটা পাত্রে রাখতে হবে সকালে রান্না করা বেঁচে যাওয়া খাবার। পিঁপড়েরা এসে কলাইয়ের থালায় বানানো জলের ঘেরাটোপ দেখে ফিরে যাবে! কিন্তু বেড়াল? তার জন্য চাই জালালমারি। ইংরেজি ‘মিট সেফ’-এর বাংলা জাল আলমারি। মুখে মুখে জালালমারি। কলাইয়ের থালায় জল, তার ওপরে বাটি, সেই বাটির ওপরে একটা বড় পাত্রে ডাল, সেই ডালের ওপর তুলনায় ছোট বাটিতে তরকারি, তার ওপরে আরও ছোট বাটিতে মাছ। এই বাঁচা খাবারের জলওয়ালা পিরামিডকে সাবধানে ঢোকাতে হবে জালের আলমারিতে। আলমারির জাল দিয়ে হাওয়া খেলে যায়। সেই জল ছোঁয়া হাওয়ায় বাটি বাটি পিরামিডের ডাল, তরকারি, মাছেরা বাবার অফিস থেকে ফেরা অবধি ভাল থাকে। মাকে বিকেলে উনুন ধরাতে হয় না। স্টোভে চা আর টুকিটাকি খাবার গরম করে নিলেই হয়।
জালালমারি আছে বলে মা বিকেল, সন্ধেবেলা গা ধুতে যেতে পারে। চৌবাচ্চার জমা জলে গা ধুয়ে, ভেজা শাড়ি গায়ে এক ছুটে শোওয়ার ঘরে চলে যায়। শোওয়ার ঘরের খাটের কোণায় ড্রেসিং টেবল। একটা কৌটোয় রাখা পাউডার গলায়, ঘাড়ে পাফ বুলিয়ে মাখে। চৌবাচ্চার পাড়ে ফেলে আসা ব্লাউজের সেফটিপিন এনে দিতে বলে দিদিকে। ভেজা কাপড় সন্ধেবেলা বাইরে মেলতে নেই বলে এক চিলতে বারান্দায় মায়ের গা ধোয়া শাড়ি ঝোলে। শোওয়ার ঘরের ঠাকুরের কুলুঙ্গিতে নকুলদানা আর ধূপ পড়ে গিয়েছে পাউডার মাখা আর শাড়ি মেলার আগেই। নিয়ম করে আলো নিভে যায়। বিকেলে গা ধুতে যাওয়ার আগে মুছে রাখা হ্যারিকেন জ্বলে ওঠে। তালপাতার পাখা জলে ভিজিয়ে হাওয়া খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে মায়ের বকুনি বরাদ্দ হয়। কারণ, এতে নাকি হাতপাখার সুতো পচে যাবে। বাবা ফেরে। স্টোভে চা চাপে। ঘণ্টা দু-তিন বাদে আলো এল। পাড়ায় আলো আসার হো চিৎকার। রেডিয়ো বাজে। বাবা খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে চা খায়। রাতের দিকে ঘড়ি এগোয়। আজ বড্ড গরম। খাওয়ার পর মাটি মুছে ঢালাও বিছানা হবে। লাল মেঝেতে ধুয়ে মুছে বিছানা পাতলে তা-ও গরম খানিক সইবে। শোওয়ার ঘরের জানলার হাফ পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়। এই জানলা দিয়ে বিছানায় শুলে চাঁদ দেখা যায় না, মাটিতে শুলে ফালি চাঁদ চোখে পড়ে। অনেক দিন চাঁদ মেঘ মাখেনি।
|
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |