ফেসবুকের স্রষ্টা মার্ক জুকারবার্গ আপন জীবনসঙ্গিনী গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠিয়াছে, তাঁহার ফেসবুক কি তরুণ প্রজন্মকে আরও নিঃসঙ্গ করিয়া তুলিতেছে? বাস্তবে বন্ধুদের সহিত বসিয়া গল্পগুজব করা, অন্তরের সংযোগ গড়িয়া তুলিবার চাইতে বর্তমান প্রজন্মের একটি বড় অংশের মধ্যে দেখা যাইতেছে ‘ভার্চুয়াল রিয়ালিটি’ বা ইন্টারনেটের কল্পিত বাস্তবে বিপুল সংখ্যক মানুষের সহিত সংযোগ গড়িয়া তোলার আর্তি। কিন্তু সেই সংযোগ, যাহা মাউসযন্ত্রে কয়েকটি ‘ক্লিক’ করিয়া, কিংবা কয়েকটি বাক্য লিখিয়াই সারা যায়, তাহা কখনওই মনুষ্য-সম্পর্কের বিকল্প হইতে পারে না। সেখানে অধিকাংশ ‘বন্ধু’ই আসলে অপরিচিত, দূর দেশবাসী, ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ। সেখানে হৃদয়ের সংযোগ গড়িয়া উঠিবার সুযোগ নাই, একের দুঃখে অপরের ভাববিকার হইবার সম্ভাবনা কম, একের বিপদে অন্যের পাশে দাঁড়াইবার প্রত্যাশা নাই, সুযোগও নাই। এই সত্যগুলিই সম্প্রতি ধরা পড়িয়াছে একটি গবেষণায়। শিকাগো ইউনিভার্সিটির স্নায়ুতন্ত্র গবেষকরা একটি সমীক্ষায় দেখিয়াছেন, যাঁহারা নিজেদের নিঃসঙ্গ মনে করিতেছেন, তাঁহারাই ফেসবুক এবং কম্পিউটারের মাধ্যমে কথাবার্তার, খেলা-বিনোদনের নানা ওয়েবসাইটে অধিকতর সময় কাটাইতেছেন। ইহাও স্পষ্ট হইতেছে যে, ফেসবুক নূতন বন্ধু লাভের সুযোগ দেয় এই ধারণা ভুল, প্রধানত পরিচিত লোকেদের সহিতই আলাপ চলে ফেসবুকেও। সংযোগের আভাস দিয়া বহু লোকের নিঃসঙ্গতাকে আরও দীর্ঘায়িত ও তীব্র করিতেছে ফেসবুক, এমন উদ্বেগ দেখা দিয়াছে।
ফেসবুকের উপর দায় চাপাইয়া কি একটি প্রজন্ম আজকের তরুণদের অন্তর্মুখী, নিঃসঙ্গ করিয়া তোলার দায় এড়াইতে চাহিতেছে? শুধু পশ্চিমে নহে, এ দেশে, এমনকী এই পশ্চিমবঙ্গের সমাজেও শিশুকিশোরদের নিঃসঙ্গ করিয়া তোলার সাধনা অহরহ চলিতেছে। যে সময়টি সঙ্গীসাথি লইয়া হইচই করিবার বয়স, যখন বন্ধুত্বই স্বাভাবিক, তখন পড়াশোনার চাপে শৈশব, কৈশোর আক্রান্ত। বিকালের অবকাশটুকুও মেলে না, সময় মিলিলেও খেলার মাঠ অন্তর্হিত, ব্রতচারীর দল কিংবা ‘সব পেয়েছির আসর’ বা ‘মণিমেলা’ হয় বিস্মৃত না হয় কোনও মতে টিকিয়া রহিয়াছে। এমনকী পাড়ার পূজা কিংবা ক্লাবের খেলা অবধি বাণিজ্যিক বিপণনের দ্বারা গ্রাস হইয়াছে, সেখানেও স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান অপেক্ষা পেশাদারি দক্ষতার কদর বাড়িতেছে, সহযোগিতার স্থলে প্রতিযোগিতাই মূল মন্ত্র হইয়া উঠিতেছে। ইহার চাপে কিশোর-তরুণরা স্বভাবতই সঙ্গীর স্পর্শ খোঁজে ফেসবুকের ন্যায় ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং’ সাইটগুলিতে। জীবনে যে সম্পর্ক অধরা রহিয়া গেল, কম্পিউটার স্ক্রিনে তাহার অবভাস যেন দুধের স্থলে পিটুলিগোলার আস্বাদন। কিন্তু দরিদ্র বালক অশ্বত্থামা আরও একটি কারণে স্মরণীয়। তাঁহাকে অভিশাপ দিয়া শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন, তিনি অমর হইবেন কিন্তু কখনও মানবসমাজে আসিতে পারিবেন না, দুর্গম স্থানে একাকী ঘুরিবেন। একবিংশের অভিশাপ, উত্তরোত্তর জনসংকুল সমাজে বাস করিয়াও একা থাকিতে হইবে। |