শুরু থেকে শেষ— আট দিনেও ‘পরিবর্তন’ হল না ছবিটার। পেশাদারি ছোঁয়ায় যতই সেজে উঠুক সরকারি মেলা, মানুষকে সে ভাবে টানতে পারল না।
পরিবর্তনের পরে রাজ্যে নতুন সরকারের এক বছরের ‘সাফল্য’ তুলে ধরতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বসানো এই মেলার উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশের হিসেবে, সায়েন্স সিটির পাশে মিলনমেলার মাঠে এক মাত্র ওই প্রথম দিনের অনুষ্ঠান বাদ দিলে বাকি দিনগুলিতে দর্শক হাতে গোনা। মূল মেলার বাইরে নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বর, অথবা ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলেও কয়েকটি সরকারি প্যাভিলিয়ন সেজে উঠেছিল। ওই তল্লাটে এমনিতেই বহু মানুষের যাতায়াত থাকে। সরকারি স্টল যে সেই পথচলতি ভিড়কেও টানতে পারেনি, এ কথা জানাচ্ছেন কতর্ব্যরত আধিকারিকরাই। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীর সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিনটি বাদ দিলে রাজ্যের মন্ত্রী থেকে সচিব-পর্যায়ের আমলাদেরও কালে-ভদ্রে দেখা গিয়েছে মেলায়। রাজ্য সরকারের ‘সাফল্যের’ খতিয়ান তুলে ধরতে এই ‘প্রগতি-উৎসব’ ঘিরে অবশ্য গোড়া থেকেই সংশয় ছিল প্রশাসনের একাংশের। মেলা শেষে সেই সংশয়টাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল।
লোক টানতে কোটি টাকা খরচ করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার সাহায্যে সৃজনশীল ঢঙে মেলার প্যাভিলিয়নগুলি সাজানো হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী যে ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর কথা বার বার বলে থাকেন, সেই মা-মাটি-মানুষকে কাছে টানতে মেলায় বাংলার লোকশিল্প, খাবার ও সংস্কৃতিকেও তুলে ধরার ব্যবস্থা হয়েছিল। |
কিন্তু সরকারি পদক্ষেপ বা প্রকল্পের নীরস তথ্যের ফিরিস্তি জানতে ভয়াবহ গরমের দুপুর-রোদে কলকাতার লোকে কেন মেলা দেখতে যাবে?
প্রশ্ন আরও, এত আয়োজনের পরে মেলা থেকে প্রাপ্তির ভাঁড়ারে কী জুটল? ‘প্রগতি-উৎসব’-এর ‘সাফল্য’ নিয়ে সরকারি তরফে এখনও মুখ খোলেননি কেউ। মেলার মূল আয়োজক রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কর্তাদের ফোন করেও সাড়া মেলেনি। এসএমএস-এরও জবাব পাওয়া যায়নি।
তবে শনিবার দুপুরে মিলনমেলার মাঠের ফুড কোর্টে শহরের একটি নামী মিষ্টির দোকানের কর্মীরা কিন্তু মেলায় যোগ দেওয়ার জন্য আফশোসই করছিলেন। একটি কেটারিং সংস্থার কর্তা বানিন্দর সিংহ বললেন, “প্রথম দিন মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অতিথিদের ‘হাই টি’-র আয়োজন করে যেটুকু লাভ হয়েছিল। তার পর থেকে আর লোক কই? টানা খেসারত দিয়ে যাচ্ছি।” পাঁচতারা হোটেলের প্রশস্ত লবির আদলে সেজেছিল শিল্প দফতরের প্যাভিলিয়ন। অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের স্টলে গ্রাম-বাংলার খোড়ো আটচালার আদল। মেলা শেষের বিকেলেও ওই সব স্টল খাঁ খাঁ করেছে।
আম-নাগরিকের এই ‘মেলা-বিমুখতা’র পিছনে কলকাতার জ্যৈষ্ঠ মাসের অসহ্য দুপুরকেও দায়ী করছেন সরকারি আধিকারিকেরা। দেখা গিয়েছে সরকারি কর্মীরাও অনেকে ভরদুপুরে স্টল ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ‘হ্যাঙ্গার’-এর মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সরকারি সাফল্যের তথ্য জানাতে মেলা উপযুক্ত মঞ্চ কি না, তাই নিয়েও অনেকের সংশয় রয়েছে।
তবু এই গরমেও যাঁরা মেলামুখো হয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই কিন্তু সাজসজ্জা ভাল লেগেছে। রবীন্দ্রভারতী-র গণমাধ্যম বিভাগের পড়ুয়াদের দলটা সে-কথাই বলছিল। পড়াশোনার কেজো তাগিদেই মেলায় এসেছিলেন সৌরভ-তানিশা-সায়নীরা। তাঁদের বক্তব্য, “এত সুন্দর করে সব-কিছু সাজানো হয়েছে, ভাবা যায় না।” পুলিশের সংগ্রহালয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা স্মারক বা জেলের বন্দিদের আঁকা ছবির প্রদর্শনীও অনেকের ভাল লেগেছে।
এক আধিকারিকের কথায়, “যাঁরা আসছেন, তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক কর্মী কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের লোক। মেলার আয়োজনের খুঁটিনাটি জানতে তাঁরা একাধিক বারও আসছেন।” অবসরপ্রাপ্ত আমলাদেরও অনেককে দেখা গিয়েছে। আর পুলিশের দাবি, সায়েন্স সিটির কাছে বাস ধরতে যাওয়া অফিসফেরত ভিড়ও মেলায় সময় কাটাচ্ছে। পুলিশের স্টলে তরুণদের চাকরির খোঁজ-খবর নিতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তাতেও মেলা শেষ পর্যন্ত জমল না। |