দূরত্ব সাড়ে ছ’কিলোমিটার। সময় প্রায় দেড় ঘণ্টা। শনিবারের বারবেলায় পথে নেমে কংগ্রেস, সিপিএম এবং আমজনতাকে একযোগে ‘বার্তা’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কংগ্রেসকে ‘বার্তা’ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জনবিরোধী’ সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নেবেন না। দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক হলেও।
সিপিএমকে ‘বার্তা’ তিনি রাস্তাতেই আছেন।
আমজনতাকে ‘বার্তা’ তিনি মানুষের পাশেই আছেন।
দলীয় সাংসদ, কেন্দ্র ও রাজ্যের মন্ত্রী-বিধায়ক ও তৃণমূলের অসংখ্য কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ‘সংগঠিত’ বিশাল মিছিলের পুরোভাগে থেকেও এদিন হাঁটতে-হাঁটতেই তাঁর নিজস্ব কায়দায় ‘জনসংযোগ’ করেছেন মমতা। হাজরা মোড়ে মিছিলের শেষে তাঁর সঙ্গে পা-মেলানো কাতারে কাতারে মানুষকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে মমতা বলেছেন, “পেট্রোপণ্যের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং ওই দাম প্রত্যাহারের দাবিতে যাঁরা মিছিলে এসেছেন, প্রত্যেককে ধন্যবাদ।” মিছিলে বারবার ঘোষণা হচ্ছিল, ‘পথই আমাদের আন্দোলনের পথ দেখাবে’। সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে মমতার নমস্কার-শুভেচ্ছায় ফুল-মালায় অভিনন্দন জানিয়েছে জনতা। সেই মানুষের কাছেই মমতার নির্দেশ, “পেট্রোলের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদে রবিবার রাজ্যের সব ব্লক ও বুথে আপনারা মিছিল করবেন।”
মমতার এই মিছিলে প্রধান বিরোধীদল সিপিএম যে খানিকটা ‘বিব্রত’, তা বোঝা গিয়েছে দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কথায়। এমনিতে, সিপিএম মনে করে, ‘দক্ষ প্রশাসকে’র চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর ‘জঙ্গি-আন্দোলনমুখী’ ভাবমূর্তি ধরে রাখলেই তাদের ‘রাজনৈতিক সুবিধা’। |
কিন্তু পেট্রোলের বেনজির মূল্যবৃদ্ধিতে রাস্তায় নেমে (মমতাই দেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি নিজে এই প্রশ্নে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলেন) মমতা যে ‘জনসমর্থন’ কুড়োচ্ছেন, তা খুব স্পষ্ট। সিপিএম ‘উদ্বিগ্ন’ মমতার সেই ‘বামপন্থী’ ভূমিকা নিয়েই।
বিমানবাবু যেমন বলেছেন, তিনি মমতার মিছিলের কোনও ‘যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা’ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, “এটার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। উনি এখন বিরোধী নেত্রী নন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দল কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের অন্যতম শরিক। উনি আপত্তির কথা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানাতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও করতে পারেন। এমনকী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকেও তৃণমূলের তরফে আপত্তির কথা জানাতে পারেন। কিন্তু তা না-করে এ ভাবে পথে নেমে আন্দোলন করে উনি নিজের বামপন্থী ভাবমূর্তি তুলে ধরে রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন।” পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে
এদিন দুপুর এবং বিকেলে কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ‘চাক্কা জ্যাম’ করেন ডিওয়াইএফআই-সহ বামপন্থী গণ-সংঠনের যুব কর্মীরা। কিন্তু প্রত্যাশিত ভাবেই, তাঁদের ‘আন্দোলন’ মুখ্যমন্ত্রী মিছিলের চেয়ে কম ‘গুরুত্ব’ পেয়েছে।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, এক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যে যে পুরভোট রয়েছে, তা-ও এদিন মমতার মিছিল করার একটি কারণ। দলের এক নেতার কথায়, “প্রতিটি পুরসভাতেই ত্রিমুখী লড়াই হচ্ছে। আমরা চাই, বাম-বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না-হয়। পেট্রোলের দাম বাড়িয়ে
কংগ্রেস যে অবিবেচক কাজ করেছে, তাতে ওরা পুরভোটে নিশ্চয়ই বেকায়দায় পড়বে। আমরা শুধু বলতে চাই, তৃণমূল ওই সিদ্ধান্তের শরিক নয়। বরং আমরা প্রতিবাদে পথে নেমেছি।”
তৃণমূলের মিছিলকে আগেই ‘কটাক্ষ’ করেছে প্রদেশ কংগ্রেস। কেন্দ্রের বিরোধিতা না করে রাজ্য সরকারকে কর কমাতে অনুরোধ করেছিলেন প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। স্পষ্টতই ক্ষুন্ন প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করছেন। তাতে মুকুল রায়-সহ অন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও আছেন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আব্দুল মান্নান, আবু হেনারা মানুষের স্বার্থে রাস্তায় নামলে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারবেন না।
স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিচ্ছি।” কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী মমতাকে পরামর্শ দিয়েছেন কর কমিয়ে ‘গোয়া-মডেল’ অনুসরণ করতে। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বিজেপি-শাসিত গোয়ার সঙ্গেই গুজরাতের
উদাহরণও দিয়েছেন।
তবে নিশ্চিত ভাবেই মমতার মিছিল সবচেয়ে বেশি ‘বিঁধেছে’ সিপিএমকে। সরকারের শরিক হয়ে মমতা পথে নামলেও সিপিএমের তাবড় নেতারা এখনও সেই রাস্তায় হাঁটতে পারেননি। দলের প্রথমসারির নেতা গৌতম দেব মমতার মিছিলকে ‘ড্রামাবাজি’ বলেছেন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, মমতা কেন এই মিছিল করলেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না!
বিমানবাবুও কি মমতার প্রতিবাদ-আন্দোলনকে ‘নাটক’ বলছেন? ‘সতর্ক’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক আলিমুদ্দিনে বলেছেন, “নাটক বলছি না। তবে উনি আর এখন শুধু তৃণমূল নেত্রী নন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও। সেটা উনি ভুলে যাচ্ছেন।” সিপিএমের এক রাজ্য নেতার ব্যাখ্যায়, “পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে মমতার পথে নামাকে নাটক বললে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। তাই বিমানবাবু ও পথে হাঁটেননি।”
আবার মমতা সে জন্যই হেঁটেছেন ‘ও পথে’। |