নিচু মানের উচ্চ ফলনশীল ধানের একবগ্গা চাষ যে আর নিরাপদ নয়, তা রাজ্যের চাষিরা গত মরসুমেই বুঝে গিয়েছেন। গোলা ভরা ধান নিয়ে বসে থেকেও ন্যায্য দাম মেলেনি। অথচ গোবিন্দভোগ ধানের চাষ ‘সুদিন’ এনে দিয়েছে বর্ধমানের রায়নায়।
মধ্যবিত্তের রুচির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় উচ্চ ফলনশীল লালচে মোটা চাল জলের দরে বেচতে হয়েছে চাষিদের। বিহার-অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে সামান্য বেশি দামের ‘সাদা চাল’ ঢুকে বাংলার বাজার দখল করছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বাজার তৈরি করে ফেলেছে রায়নার গোবিন্দভোগ। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চাল যাচ্ছে পশ্চিম এশিয়াতেও।
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন রায়নায় গিয়ে রফতানির বহর শুনে চাষি ও চালকল মালিকদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পরে দিল্লির প্রগতি ময়দানে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার-এ রাজ্য সরকারের এক অনুষ্ঠানে রায়নার গোবিন্দভোগ দিয়ে পায়েস করান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। মুগ্ধ অতিথিরা চারিদিকে তার সুখ্যাতি করেছেন। |
চলছে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার আগে প্রস্তুতি। ছবি: উদিত সিংহ |
বর্ধমান জেলা কৃষি বিপণন দফতরের সহকারী অধিকর্তা প্রিয়দর্শী সেন বলেন, “নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় চাষ ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মেলায় অন্যতম সেরা চালের সম্মান পেয়েছে রায়নার গোবিন্দভোগ। তার পর থেকে মাঝে-মধ্যেই দিল্লির নানা বিশিষ্ট মানুষের অনুরোধে গোবিন্দভোগ পাঠাতে হচ্ছে।” উত্তর দিনাজপুরের তুলাইপঞ্জি, জলপাইগুড়ির কাটারিভোগের সঙ্গে গোবিন্দভোগও বিদেশের বাজারে কদর পাবে বলে তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন।
গোবিন্দভোগ চাষ হয় জুন-জুলাইয়ে, কাটা হয় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। কিন্তু এই ধান আদৌ উচ্চ ফলনশীল নয়। রায়নার বাসুদেবপুরের চাষি দলীপ সামন্তের কথায়, “উচ্চ ফলনশীল ধান যেখানে বিঘায় ১২-১৩ বস্তা হয়, গোবিন্দভোগ মেলে বড় জোর আট বস্তা।” এঁটেল মাটির এই চাষে কিন্তু ঝঞ্ঝাটও আছে। বর্ষায় খেতে কাঁকড়ার উপদ্রব হয়। তারা রোয়া ধানের গোড়া কেটে ফেলে। তাই রোজ মাঠে গিয়ে নজর রাখতে হয়। ধানের থোড় এলে আবার সুগন্ধে নানা পোকামাকড় আকৃষ্ট হয়। অন্তত ৮-১০ বার পোকা মারার ওষুধ দিতে হয়।
কিন্তু চাষের পরে চাষিরা অনেক বেশি নিশ্চিন্ত। কেননা যেখানে চাষের খরচ কুইন্টালে ৭০০-৮০০ টাকা, বাজারে দাম মেলে প্রায় দ্বিগুণ। অপেক্ষাকৃত নতুন গোবিন্দভোগ কুইন্টাল পিছু ১৫০০ টাকা এবং কয়েক মাসের পুরনো চাল কুইন্টাল পিছু ১৯০০ টাকায় বিক্রি হয়। পুরনো ধানের দাম পড়ে যাওয়ায় বোরো চাষিদের যখন মাথাখারাপ, রায়নার বহরপুরের চাষি শেখ নিয়ামুল হক বলছেন, “আমরা বরং যত দিন সম্ভব গোলায় ধান রাখার চেষ্টা করি। তাতে বস্তা পিছু অন্তত ৫০০-৭০০ টাকা বেশি দাম মেলে। গত বার তো কুইন্টালে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত দর উঠেছিল।” স্বাভাবিক ভাবেই, আর সব ধানের চাষ বন্ধ করে নিজের ১২ বিঘে জমিতে এখন শুধু গোবিন্দভোগই ফলাচ্ছেন দলীপবাবুরা।
বর্ধমান জেলা ধানকল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি জয়দেব বেতাল বলেন, “রায়নার অন্তত ২৫টি চালকল শুধু গোবিন্দভোগ উৎপাদন করে। বছরে প্রায় ১০ হাজার টন চাল হয়।” এই চালের সিংহ ভাগ যায় কেরল, তামিলনাড়ু, কর্নাটকের মতো দক্ষিণের রাজ্যে। সেখানে গোবিন্দভোগ দিয়ে বিরিয়ানি, নাইচোর বা ঘি-ভাত তৈরি করা হয়। এক সময়ে গোবিন্দভোগের বাজার তৈরি করতে দক্ষিণে পড়ে থাকতেন চালকল মালিকেরা। এখন তাঁরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বরাত নেন। তাঁদের ঠিকানায় চলে আসে ধানের দামের চেক। রায়নার এক ধানকলের অন্যতম মালিক কৃষ্ণচন্দ্র গণের কথায়, “সব খরচ-খরচা মিলিয়ে প্রতি কুইন্টাল ৩৬০০-৩৭০০ টাকা দাম পাই।” এই পরিস্থিতিতে রায়না থেকে প্রায় গুটিয়ে যেতে বসেছে বাজার চলতি লালস্বর্ণ, রত্না, আইআর প্রজাতির ধান, দাবি শেখ নিয়ামুলের মতো চাষিদের। স্থানীয় জ্যোৎসাদি গ্রামের মির্জা নিয়ামুল হক বলেন, “আগে অন্য প্রজাতির ধান চাষ করে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হত। তার বাজার অনিশ্চিত। কিন্তু গোবিন্দভোগের মার নেই। গত ক’বছর ধরে ১২ বিঘে জমিতে গোবিন্দভোগই চাষ করছি।”
বর্ধমানের উপ-কৃষি অধিকর্তা শ্যামল দত্ত বলেন, “রায়নার মাটির গুণেই গোবিন্দভোগ ভাল হয়। সেটা অন্য জায়গায় অত ভাল হবে না। কিন্তু ধানের বীজ ব্যবহারে বৈচিত্র আনতে পারলে তবেই চাষিরা উপকৃত হবেন।” প্রিয়দর্শীবাবুর আক্ষেপ, “এই জেলায় এক সময়ে প্রায় সাড়ে চারশো প্রজাতির উৎকৃষ্ট ধানের চাষ হত। শুধু মাত্র উচ্চফলনশীল নয় বলেই সেগুলি পিছু হটে গিয়েছে।” এখন ফের উৎকৃষ্ট ধানের চাষ ফেরানোর চেষ্টা করছে কৃষি বিপণন দফতর। শুধু পরিমাণ নয়, মানও যে জরুরি এই ‘পুরনো চিন্তা’ও ফিরছে। |