ধান-গম-আলু-পাটের ‘অনিশ্চিত’ ফলনের বাইরে বেরিয়ে নদিয়ার ফুলিয়া ও বাঁকুড়ার সোনামুখীর বহু কৃষিজীবী লাভের মুখ দেখেছেন স্ট্রবেরি চাষ করে। নদিয়ারই হরিণঘাটা, নবদ্বীপ, হাঁসখালির একাধিক চাষি চাষ শুরু করছেন বেল পেপারের। লক্ষ্য একটাই, প্রথাগত ফসলের বাইরে বেরিয়ে বিকল্পের হাত ধরে লাভ করা। এই কাজে তাঁদের প্রযুক্তিগত ও প্রশিক্ষণগত সাহায্য দিচ্ছে এই জেলারই গয়েশপুরের কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্র।
প্রথাগত চাষের সঙ্গে ‘ঝুঁকি’ বা ‘অনিশ্চয়তা’ কতটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে, এ রাজ্যে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আলু। কখনও অতিফলনের জেরে মার খান আলু চাষিরা, আবার কোনও মরসুমে আবহাওয়াজনিত খামখেয়ালিপনায় ফলন নষ্ট হয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। বারবার সেই অভিজ্ঞতা থেকে ঠেকে শিখেই তাই বাঁকুড়ার মতো আলু উৎপাদক জেলাতেও পরীক্ষামূলক ভাবে অনেক চাষি স্ট্রবেরি চাষ শুরু করেছেন। দেখেছেন লাভের মুখ। কৃষি প্রধান বর্ধমানের কালনা মহকুমাতেও বহু চাষি ধান-আলু ছেড়ে পেয়ারা, সর্ষে ও ফুল চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। |
গয়েশপুরের কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্রে বেল পেপারের চাষ। নিজস্ব চিত্র। |
নদিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। গয়েশপুরে কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্রের পাঁচ কাঠা জমিতে ‘পলি হাউস’-এর মধ্যে জৈব প্রক্রিয়ায় পরীক্ষামূলক ভাবে উৎপাদন হচ্ছে লাল, হলুদ, মেরুন, বেগুনি-সহ নানা রঙের বেল পেপার (রঙিন ক্যাপসিকাম হিসাবেই যা বেশি পরিচিত)। এই কেন্দ্র থেকেই হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে হরিণঘাটা, নবদ্বীপ, হাঁসখালির জনা দশেক চাষি গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রথমবার বেল পেপার চাষ করেছেন। চারার জোগান দিচ্ছে কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্রই।
মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি পরামর্শদাতা প্রদীপ মজুমদারের কথায়, ‘‘কৃষিজীবীদের আয় বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিকল্প চাষের বিষয়ে উৎসাহী। বেল পেপারের বাজার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিদেশের বাজার ধরারও উদ্যোগ রয়েছে। নদিয়ায় শুরু হয়েছে ঠিকই, তবে অন্য জেলাতেও এই অর্থকরী ফসলের চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
মূলত সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেল পেপার উপাদন হলেও বাণিজ্যিক কারণেই অসময়ে ফলন ফলাতে উদ্যোগী হয়েছেন গয়েশপুর কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্রের কৃষি বিজ্ঞানীরা। বস্তুত, পলি হাউসে উষ্ণতা ও আর্দ্রতাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বছরভর এই চাষ সম্ভব বলেও দাবি কৃষি বিজ্ঞানীদের। পলিহাউস তৈরিতে অবশ্য লাখখানেক টাকা লাগবে। তবে, তা একবারের খরচা। কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্রের উদ্যানপালন বিশেষজ্ঞ মলয়কুমার সামন্ত বলেন, ‘‘১২০০ চারা লাগালে ১৪০০ কেজি বেল পেপার মেলে। এর জন্য খরচ ৩৫,৫০০ টাকা। আয় হয় আনুমানিক ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। আমরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কৃষকদের চারা তৈরি করে দিচ্ছি। ফলন হওয়া বা বাজারজাত করা পর্যন্ত যাবতীয় পরামর্শ দিচ্ছি। কৃষক পরিবারের নতুন প্রজন্মও এতে আগ্রহী হচ্ছে।’’
বাজারে বেল পেপারের চাহিদা যথেষ্ট। চিলি চিকেন থেকে চাউমিন, রোল থেকে কাবাববাঙালির রসনায় আদি-অকৃত্রিম সবুজ ক্যাপসিকামের ঠাঁই কার্যত পাকা। বেল পেপারের জনপ্রিয়তা বাড়লে তা-ও রেস্তোরাঁর পাশাপাশি গৃহস্থের হেঁসেলেও স্থায়ী ভাবে ঢুকে পড়তে পারবে বলে কৃষি-বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস। কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্রের জমিতে তিনটি পলি হাউসে যে বেলপেপার চাষ হচ্ছে, তা কলকাতার বাজারে (মূলত নিউমার্কেট) সর্বাধিক ৪০০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়েছে। অক্টোবর-নভেম্বরে দাম বেশি থাকলেও শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমতে থাকে( ৮০-১০০ টাকা কেজি)।
চাষিদের আর্জি, স্ট্রবেরি যেমন মাদার ডেয়ারির কাউন্টারের মাধ্যমে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তেমনটা বেলপেপারের ক্ষেত্রে হলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করতে সুবিধা হবে। বেলপেপার বাজারজাত করার জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে। বিধানচন্দ্র কৃষি শ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সরোজকুমার সান্যাল বলেন, ‘‘আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা সব সময় চেষ্টা করছেন, কৃষকদের নতুন ধরনের ভাবনা ভাবাতে। সাড়াও মিলছে। সরকারও এই বিষয়ে উদ্যোগী।”
যে দশ জন চাষি বেলপেপার চাষ করেছেন, তাঁদের অন্যতম নবদ্বীপের ফারহাদ বা হরিণঘাটার ভবানীপুর এলাকার বাসিন্দা পিন্টু মণ্ডল বলেন, “পলিহাউস তৈরিতে কৃষি-বিজ্ঞান কেন্দ্রের সাহায্য পেয়েছি। গত শীতে কেজিতে ২৫০ টাকা দরও পেয়েছি স্থানীয় বাজারে। ঠিকমতো চাষ করতে পারলে প্রায় ৪০ শতাংশ লাভ।”
এই লাভের পথেই নদিয়া সবে হাঁটতে শুরু করেছে। আরও জেলা হাঁটে কি না, এখন সেটাই দেখার। |