জয় হল মেধার। জয় হল মানের।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি প্রতাপ রায় ও বিচারপতি সুবল বৈদ্যের ডিভিশন বেঞ্চ বৃহস্পতিবার তাদের রায়ে জানিয়ে দিল, উচ্চশিক্ষায় মেধা বা মানের সঙ্গে সমঝোতার কোনও সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের মতে, দুর্গম ও উপদ্রুত এলাকার হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে বাড়তি ৩০ নম্বর দেওয়ার সরকারি বিজ্ঞপ্তি অসাংবিধানিক, অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন। তাই সেটি স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বারবার বলেছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মান ও মেধার সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা করা যাবে না। এ দিন রায় দিতে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সেই নির্দেশের প্রসঙ্গও টেনে আনেন বিচারপতি রায়।
হাইকোর্টের এ দিনের রায়ের ফলে আজ, শুক্রবার থেকেই এমডি এবং এমএস পাঠ্যক্রমে ভর্তির কাউন্সেলিং শুরু হবে। মেধা-তালিকা অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার উত্তীর্ণদেরই ভর্তি নেওয়া হবে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে।
দুর্গম ও উপদ্রুত এলাকার হাসপাতালের চিকিৎসকদের বাড়তি নম্বর দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল গত ২৩ নভেম্বর। সেই বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা হয় হাইকোর্টে। সিঙ্গল বেঞ্চ রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি বহাল রাখে। কিছু সরকারি চিকিৎসক ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করেন। তাঁদের প্রশ্ন, কীসের ভিত্তিতে এবং কোন বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে দুর্গম ও উপদ্রুত এলাকা চিহ্নিত হল? ফাঁসিদেওয়া হাসপাতালে কর্মরত এক আবেদনকারীর হয়ে রাজ্যের প্রবীণতম আইনজীবী কাশীকান্ত মৈত্র সওয়ালে বলেন, এ ভাবে যদি মেধার সঙ্গে আপস করা হয়, সেটা চরম অমঙ্গল ডেকে আনবে।
কয়েক জন সরকারি চিকিৎসকের পক্ষে আইনজীবী রাজর্ষি হালদার হাইকোর্টে জানান, কোনও ভিত্তি ছাড়াই দুর্গম ও উপদ্রুত এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে রাজ্য সরকার। ফলে হিঙ্গলগঞ্জ, করিমপুর, শিলিগুড়ি মহকুমার সব হাসপাতাল অত্যন্ত সুগম্য এবং নাগরিক সুবিধাযুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। মালদহ, বহরমপুর, বাঁকুড়া জেলার সব হাসপাতালই দুর্গম এলাকায় বলে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
বিচারপতি প্রতাপ রায় এ দিন অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকার কীসের ভিত্তিতে বা কোন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্গম ও উপদ্রুত এলাকার হাসাপাতাল-তালিকা তৈরি করল, তা জানার কোনও উপায় নেই। সরকারও জানাতে পারেনি। বলা হয়েছে, দুর্গম ও উপদ্রুত। শুধু দুর্গম নয়, উপদ্রুতও হতে হবে। উপদ্রুতের সংজ্ঞা কী, কোথাও সেটা বলা নেই। কোনও সরকার যে এমন একটা ভিত্তিহীন, যুক্তিহীন এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে, তা ভাবা যায় না।
রায় দেওয়ার সময় একটি উদাহরণও দেন বিচারপতি রায়। ভর্তি পরীক্ষা হয় ২০০ নম্বরের। মেডিসিনে এমডি পদের দু’টি আসন। ধরা যাক, তথাকথিত দুর্গম এলাকায় কাজ করেন না, এমন এক জন চিকিৎসক ভর্তি পরীক্ষায় ১৩০ পেয়েছেন। দুর্গম এলাকায় কর্মরত অন্য দুই চিকিৎসক ওই পরীক্ষায় পেয়েছেন ১১০। ফাউ নম্বরের দৌলতে ওই দুই চিকিৎসক ১৪০ পেয়ে যাবেন। বঞ্চিত হবেন যোগ্যতামানে অনেকটা উপরে থাকা প্রথম চিকিৎসক। এই যদি চলতে থাকে, তা হলে উচ্চশিক্ষার মানের কী হাল হবে? যোগ্যতাসম্পন্ন, মেধাবী চিকিৎসকেরা মানসিক ভাবে আহত হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজ্য, দেশও। অনেক ভাল বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক পাওয়া থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। দেশের মানবসম্পদের এমন অপচয় চলতে পারে না। কোনও মতেই কম মেধার প্রার্থীকে ঘুরপথ দিয়ে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে ঢুকতে দেওয়া যায় না।
ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের উপরে স্থগিতাদেশের আবেদন জানিয়েছিল সরকার পক্ষ। ডিভিশন বেঞ্চ তা খারিজ করে দেয়। তাদের বক্তব্য, যাঁরা পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েছেন, তাঁরাই সরকারি চিকিৎসকদের জন্য নির্দিষ্ট ২৫৩টি আসনে ভর্তি হবেন। দুর্গম এলাকায় কাজ করার জন্য যদি উৎসাহিত করার প্রয়োজন হয়, অন্য বাড়তি সুযোগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু বাঁকা পথে এমডি, এমএসের মতো উচ্চ পাঠ্যক্রমে কাউকে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে না। গ্রীষ্মাবকাশের পরে মূল মামলার শুনানি হবে। |