ভূগর্ভের জল বাঁচাতে ‘জল ধরো-জল ভরো’ প্রকল্পে জোর দিচ্ছেন যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সেই পশ্চিমবঙ্গেই মাটি থেকে অবাধ জল উত্তোলনে কার্যত ছাড়পত্র দিয়ে দিল ক্ষুদ্রসেচ দফতর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত নীতির উল্টো পথে হেঁটে তারা নতুন যে নীতি তৈরি করেছে, তাতে রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের ৩০৩টিতেই অগভীর নলকূপ বসানোয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে। দফতরের দাবি, কৃষকদের স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত।
কিন্তু পরিবেশবিদ ও ভূ-বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এর ফলে ভূগর্ভের জলস্তর শুধু দ্রুত নামবেই না, নিত্যনতুন ব্লকে পানীয় জলের উৎসে ছড়িয়ে পড়বে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইডের বিষ। আরও দুর্বল হয়ে পড়বে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, সামান্য তীব্রতার ভূমিকম্পেই টলে যাবে মাটি। উপরন্তু যে কৃষকদের কথা সরকার ভাবছে, যথেচ্ছ জল তোলা হলে শেষ পর্যন্ত তাঁরাও আর চাষের জন্য পর্যাপ্ত জল পাবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। |
নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনই যে রাজ্যে পানীয় জলে আর্সেনিক-ফ্লুওরাইড দূষণের মূল কারণ, তা নিয়ে বিজ্ঞানী- গবেষকেরা একমত। রাজ্যের ৮১টি ব্লকে ভূগর্ভস্থ জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক এবং ৪৯টিতে বিপজ্জনক মাত্রার ফ্লুওরাইড মেলার পরে, ২০০৫-এ ভূগর্ভস্থ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ) আইন বানিয়েছিল রাজ্য। এ ছাড়া জলস্তর বহু নীচে নেমে যাওয়া ৩৮টি ব্লককে আনা হয়েছিল ‘কালো তালিকা’য়। রাজ্যের তদানীন্তন সরকারের যুক্তি ছিল, শিল্পায়নের স্বার্থেই ভূগর্ভস্থ জলসম্পদের সংরক্ষণ ও যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি।
এবং সেই আইনে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নতুন করে বিদ্যুৎচালিত পাম্পসেট বসানো কার্যত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। চাষের জন্য অগভীর নলকূপ মারফত জল তুলতে পাম্পসেট বসানোর আগে জল অনুসন্ধান দফতরের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সেই অনুমোদন দেখাতে না-পারলে বিদ্যুৎসংস্থার কাছ থেকে পাম্পের জন্য লাইন মিলত না। শহরাঞ্চলে বাড়ি, স্কুল-কলেজ, আবাসনেও গভীর নলকূপ বসানোয় জারি হয় নিয়ন্ত্রণ।
কিন্তু রাজ্যের নতুন সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশিকায় বিধি-নিষেধগুলি যারপরনাই শিথিল করা হয়েছে। নির্দেশিকা মোতাবেক, ‘কালো তালিকা’র ৩৮টি ব্লক ছাড়া কোথাও সেচ-নলকূপের পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য জল অনুসন্ধান দফতরের অনুমতি লাগবে না। এমন এক-একটা অগভীর নলকূপ মারফত ৫ ঘণ্টায় ৩০ হাজার লিটার পর্যন্ত জল তোলা যাবে। ফৌজি ক্যান্টনমেন্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ৫ ঘণ্টায় ১০ হাজার লিটার পর্যন্ত জল তোলার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
এ হেন সিদ্ধান্তকে ‘দু’পা এগিয়ে দশ পা পিছিয়ে আসা’ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা। এমনকী জনস্বাস্থ্য কারিগরি, ক্ষুদ্রসেচ ও জল অনুসন্ধানের কিছু বিশেষজ্ঞেরও আশঙ্কা, এতে রাজ্যে ভূ-পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এঁদের অনেকের বক্তব্য, ২০১০-এ দক্ষিণবঙ্গ অনাবৃষ্টির কবলে পড়েছিল। তাই ২০০৯-এ ভূগর্ভস্থ জলস্তরের নিরিখে ‘নিরাপদ’ ঘোষিত ব্লকগুলোর বর্তমান অবস্থা কেউ জানে না। “তা ছাড়া সরকারের বেঁধে দেওয়া পরিমাণের চেয়ে বেশি জল তোলা হলেই বা ঘণ্টায় ঘণ্টায় গিয়ে দেখবে কে?” প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
নলকূপে নিয়ন্ত্রণ উঠল কেন?
ক্ষুদ্রসেচ-সূত্রের খবর: এ বারের রাজ্য বাজেটে পশ্চিমবঙ্গে ‘কৃষি বিপ্লব’-এর ডাক দেওয়া হয়েছে। আর তার জন্যই আইন শিথিল। নতুন সরকারের মতে, ভূগর্ভে জল সংরক্ষণের নামে ছোট সেচ-পাম্প বসানোয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কার্যত কৃষকদের ভাতে মারার ব্যবস্থা হয়েছিল। ‘কৃষি বিপ্লবের’ পথে এই ‘অন্তরায়’ দূর করতেই নয়া নির্দেশিকা জারি হয়েছে বলে ক্ষুদ্রসেচ দফতরের বক্তব্য। ক্ষুদ্রসেচ-সচিব সুব্রত বিশ্বাসের দাবি, সেচের জল পেতে চাষিদের ভীষণ সমস্যা হচ্ছিল। এতে তার সুরাহা হবে। সচিবের কথায়, “ডিজেল-পাম্প চালাতে গিয়ে চাষিরা দামে কুলাতে পারছিলেন না। এখন বিদ্যুৎচালিত পাম্পে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় সেচের জলের দাম কমতে শুরু করেছে।”
সিদ্ধান্তটি ভূগর্ভে বিপদ ডেকে আনবে না?
সচিব অবশ্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ দেখছেন না। তাঁর যুক্তি, “পশ্চিমবঙ্গে চাষের জমি এত ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত যে, অধিকাংশ চাষির স্বল্পশক্তির পাম্পেই কাজ চলে যাবে। আর যত বেশি ছোট বিদ্যুৎ-পাম্প বসবে, তত ফলনের উন্নতি হবে।” বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎচালিত সেচ-পাম্পের ‘অপ্রতুলতা’য় (২০%) উদ্বেগ প্রকাশ করে সুব্রতবাবুর মন্তব্য, “পঞ্জাব-হরিয়ানা-তামিলনাড়ুতে এটা ৮০%। কেন্দ্রও সেচ-পাম্প বিদ্যুদয়নকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির আওতায় এনেছে।” দফতরের কিছু কর্তা এ-ও বলছেন, “জল না-তুললেই তা ভূগর্ভে সঞ্চিত থাকবে, এমন কোনও কথা নেই। বরং তা বয়ে যাবে অন্য দিকে। যা দিয়ে লাভ তুলবেন অন্য রাজ্যের চাষিরা।”
কিন্তু সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে সরকার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিল না কেন?জলসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র বলেন, “কেন্দ্রীয় খরা কমিশনের সম্মতিক্রমেই সিদ্ধান্তটি হয়েছে।” মন্ত্রীর যুক্তি, “রবি চাষে কম জল লাগে, দু’-তিন ঘণ্টা পাম্প চালালেই যথেষ্ট। তবে বোরোয় মাসখানেক জল ধরে রাখতে হয়। সেই সময়টা এক মাস তিন দিন অন্তর পাঁচ ঘণ্টা পাম্প চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এতে ভূগর্ভের জলসঞ্চয় নষ্ট হবে না।”
|
(সহ প্রতিবেদন: প্রভাত ঘোষ) |