ফট-ফট-ফট!
বছর খানেক আগের কোনও রাতেও টানা এমন শব্দ শুনলেই ঝপাঝপ দরজায় খিল পড়ত সারেঙ্গায়। ঘরে বসে কাঁপতেন সারেঙ্গাবাসী। জানতেন, গুলির লড়াই শুরু হয়েছে যৌথ বাহিনী আর ‘বনপার্টি’র (মাওবাদী)। আর হতও তাই।
এখনও মাঝেমাঝেই শব্দটা হয় ‘ফট-ফট-ফট’। কিন্তু তাতে আর ডরান না এলাকার বাসিন্দারা। জানেন, শব্দটা কোনও বিয়েবাড়ি থেকে আসছে। বাজি কিংবা আতসবাজির। রাতবিরেতে বাজি পোড়ানো দেখতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মহিলারাও নির্ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়েও পড়ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, “এটা পরিবর্তিত সারেঙ্গা।”
যাচ্ছিলাম বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। শালবনির জঙ্গল পেরিয়ে কনেযাত্রীদের গাড়ি যখন সারেঙ্গা সদরের কাছাকাছি ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে ৮টা-৯টা। রাস্তায় ছোট গাড়ি, মোটরবাইক নিয়মিত চোখে পড়ছে। একটা-দু’টো সাইকেলও। গাড়ি যতই ঘনবসতির দিকে এগিয়েছে, ততই চোখে পড়ছে রাস্তায়, রাস্তার পাশে মানুষজনের জটলা। পথের পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে কেউ বিড়িতে সুখটান দিচ্ছেন, কেউ বা চায়ের কাপ হাতে গল্পে মত্ত। কালভার্টে বসে পুরুষদের সঙ্গে মহিলারাও গল্পগুজব করছিলেন। সারেঙ্গা বাজারে ঢোকার পথে দেখা গেল, একাধিক মোটরবাইকে পুরুষ চালকের পিছনে রয়েছেন মহিলা আরোহী।
বিয়েবাড়িতে দেখলাম, অত রাতেও ভিড় কমেনি। সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হইচই, হুল্লোড় চলছে পুরোদমে। রাত বাড়ছিল জমছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে গল্প।
তখনই শুনলাম, বছর পাঁচেক ধরে রাতের সারেঙ্গায় এমন দৃশ্য দেখা যেত না। নিমন্ত্রিত দুই বধূ বললেন, “সন্ধ্যার পরে বাড়ি থেকে বেরনো তো দূর, ঘরের মধ্যে থাকলেও স্বস্তি আসত না। কী হয়-কী হয়, এমনই অস্বস্তিতে বুক কাঁপত। আর ওই ‘ফট-ফট-ফট’ শুরু হয়ে গেলে তো কথাই নেই!” স্থানীয় বাসিন্দাদের স্মৃতিচারণ, তখন দিনের আলো ফুরনোর সঙ্গে সঙ্গে সুনসান হয়ে যেত রাস্তাঘাট। ৭টা-সাড়ে ৭টা বাজলেই দরজা-জানলা বন্ধ করে সবাই বাড়ির ভিতরে। কাজে বেরনো কোনও সদস্য বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত উদ্বেগের শেষ নেই। দিনের বেলাতেও আতঙ্ক ছায়া-সঙ্গী হয়ে থাকত।
কেন ওই আতঙ্ক?
নাম না প্রকাশ করার শর্তে সারেঙ্গা সদরের এক বৃদ্ধ বললেন, “বছর পাঁচেক আগে থেকে এই এলাকায় বনপার্টির উপদ্রব বাড়ে। সে পর্ব চলেছে গত বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত। একটা সময় ছিল জোড়া-বিপদ। দিনে এলাকায় রুটমার্চ করত যৌথ বাহিনী। রাস্তায় আটকে বা যখনতখন বাড়িতে ঢুকে তারা ‘বনপার্টি’র গতিবিধির খবর জানতে চাইত। মাঝেমধ্যে সে জন্য জোয়ান ছেলেদের লাঠিপেটা করত। আর রাত নামলেই ডাক পড়ত ‘বনপার্টির মিটিং’-এ। দিনের বেলায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে কথা বলার জন্য তারা আবার মারধর করত!” সারেঙ্গা সদরের অদূরে তেলিজাত গ্রামের কিছু বাসিন্দা আবার বললেন, “জোয়ান ছেলে দেখলেই পুলিশ মাওবাদী বলে ধরে নিয়ে যেত। আর মাওবাদীরা জোয়ান ছেলেদের দলে টানার জন্য জবরদস্তি করত। আমরা তখন শাঁখের করাতের সামনে।”
আতঙ্ক এতটাই এলাকার মানুষজনকে ঘিরে ধরেছিল যে বিয়ে-বউভাতের মতো অনুষ্ঠানও রাতে করার কথা ভাবতে পারতেন না তাঁরা। দিনের আলো থাকতে-থাকতেই অনুষ্ঠান শেষ করে ফেলা হত। কয়েকজন বললেন, “এই যে আপনারা রাতে সারেঙ্গা পৌঁছলেন, আগে হলে সন্ধ্যার আগে এখানে পৌঁছতে হত। এত রাতে এলে আর বিয়ে দেখতে হত না।”
আতঙ্কের সেই দিন-রাত আপাতত অতীত। কী করে এই ‘পরিবর্তন’? ধরমপুর গ্রামের কিছু বাসিন্দা জানান, মূলত ছত্রধর মাহাতো ধরা পড়ার পরে ছবিটা বদলেছে। বাঁকুড়া পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “বহু মাওবাদী ও জনগণের কমিটির নেতা-কর্মী ধরা পড়েছে। প্রতিদিনই তল্লাশি হয় এবং রাস্তায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তাতেই উন্নতি হয়েছে সামগ্রিক পরিস্থিতির।” লালগড়ের সীমানা ঘেঁষা মাকড়কোল গ্রামের এক বৃদ্ধা বলেই ফেললেন, “দিনে বাহিনী আর রাতে বনপার্টি দু’পক্ষের লোকেরাই বড্ড জ্বালাত বাবা। এখন অনেক শান্তিতে আছি।” |