এ যেন উলটপুরাণ!
বিনিময় প্রথাকে ছাপিয়ে গিয়ে এক সময় মাথা তুলেছিল মুদ্রা অর্থনীতি। সে সব প্রাচীন ইতিহাসের কাহিনি। হালে কিন্তু খুচরো ‘মুদ্রা’র সঙ্কটে ফের সেই বিনিময় প্রথারই শরণ নিতে হচ্ছে!
খুচরো না থাকলে লজেন্স দিয়ে হিসেব মিলিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি চালু রয়েছে অনেক জায়গাতেই। খুচরো পয়সার বদলে লজেন্স নিয়ে কী করবেন, সেটা অবশ্য বুঝে উঠতে পারেন না অনেকে। জগদ্দলের অটোচালকরা আরও এক ধাপ এগিয়ে সেই সমস্যারও ‘অভিনব’ সমাধান করে ফেলেছেন। তাঁরা বলে দিচ্ছেন, হাতে লজেন্স জমে গেলে যাত্রীরাও পয়সার বদলে ওই লজেন্স দিয়েই ভাড়া মেটাতে পারবেন!
অর্থাৎ, লজেন্সই হয়ে উঠছে খুচরো পয়সার বিকল্প। ধরা যাক, অটোয় পাঁচ টাকা ভাড়া। যাত্রী যদি দশ টাকার নোট দেন, খুচরো না থাকলে অটোচালক যাত্রীকে পাঁচটি লজেন্স দিলেন! এ বার ফিরতি পথে ওই পাঁচটা লজেন্স দিয়েই আপনি ভাড়া মিটিয়ে দিতে পারবেন। এতে আপত্তি করবেন না ওই রুটের অটোচালকরা। জগদ্দল-ফেরিঘাট রুটের চালক বিজয়কুমার বলেন, “চিন্তার কোনও কারণ নেই। ফেরার সময় খুচরো না থাকলে ওই লজেন্স দিয়ে দেবেন। আমরাই আবার নিয়ে নেব।”
এ তো গেল জগদ্দলের কথা। অন্যত্র কিন্তু খুচরোর অভাবে নিয়মিত হেনস্থা হতে হচ্ছে মানুষকে। রবিবার দুপুরে যাদবপুর থেকে হাওড়াগামী এগ্জিকিউটিভ ক্লাসের বাসে রাসবিহারী মোড় থেকে ওঠা এক বৃদ্ধের কাছে খুচরো ছিল না। বাসের কন্ডাক্টর রীতিমতো অপমান করে তাঁকে নামিয়ে দিলেন বাস থেকে। একই রকম হেনস্থা জুটল রুবি মোড় থেকে ভলভো বাসে টালিগঞ্জ যাওয়ার জন্য ওঠা এক মহিলার কপালেও। রাস্তায় বাস থামিয়ে তাঁকেও নামিয়ে দেওয়া হল। রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রর অবশ্য দাবি, যে সব বাসযাত্রী খুচরো দিতে পারছেন না, কন্ডাক্টররা তাঁদের বিনা ভাড়ায় যাতায়তের সুযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। খুচরো পয়সার অভাবে সরকারি বাসে দৈনিক কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
কিন্তু কেন এই সমস্যা? কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় খুচরো পয়সার জোগান অনেক কমে গিয়েছে বলেই এই অবস্থা। আরবিআই-এর কর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্যে প্রতিদিন ১, ২ এবং ৫ টাকা মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি ‘কয়েন’ প্রয়োজন হয়। কিন্তু পাওয়া যায় ৭০ লক্ষ কয়েন। ফলে রোজই প্রায় ৮০ লক্ষের ঘাটতি থেকে যায়।
শুধু বাস-ট্রাম নয়। খুচরোর অভাবে কোথাও বেশি দাম দিয়ে মাল কিনতে হচ্ছে, কোথাও বা কিনতে হচ্ছে প্রয়োজনের বেশি জিনিস। টোল প্লাজায় খুচরোর বদলে দেওয়া হচ্ছে সাবান। বারবার টোল প্লাজা দিয়ে যাঁরা যাতায়াত করেন, তাঁদের বাড়িতে এখন সাবানের স্তূপ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মী ও অফিসারদের সংগঠন ‘ইউনাইটেড ফোরাম অফ আরবিআই অফিসার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ’ অবশ্য শুধু জোগানের অভাবের ব্যাখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। মানুষকে খুচরো পয়সা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে তারা। ফোরামের তরফে সুদীপ্ত সাহারায় বলেন, “আরবিআই যে পরিমাণ খুচরোর বরাত দেয়, টাঁকশাল থেকে সেই পরিমাণ খুচরো দেওয়া হচ্ছে না, এটা ঠিক। কিন্তু সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়নি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সঙ্কট বাড়তেই থাকবে।” |