আমেরিকার সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রকাশ্যে ইরানের বিরুদ্ধে রণংদেহী মনোভাব দেখাতে রাজি নয় ভারত। এ ক্ষেত্রে বরং কূটনৈতিক ভারসাম্য রেখেই চলারই পক্ষপাতী নয়াদিল্লি। তবু চলতি আর্থিক বছরে ইরান থেকে তেল আমদানি ১১ শতাংশ কমাবে ভারত। মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন ভারতে ঘুরে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকারের এই সিদ্ধান্তকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলি।
প্রকাশ্যে কেউ মন্তব্য না করলেও ঘরোয়া রাজনৈতিক আলোচনায় এমন মন্তব্য উঠে আসছে যে, আমেরিকার চাপেই তেল আমদানির ক্ষেত্রে ইরান-নির্ভরতা থেকে সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে নয়াদিল্লি। কিন্তু কোনও ভাবেই যাতে এই বার্তা না যায়, এমনকী এই সিদ্ধান্তকে যাতে কূটনীতির সঙ্গে জড়ানোই না হয়, সে বিষয়েও সর্তক রয়েছে ইউপিএ সরকার। রাজ্যসভায় আজ ইরান থেকে তেল আমদানি কমানোর কথা ঘোষণা করার পরে প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ এ-ও জানাতে ভোলেননি যে, “কোন দেশ থেকে তেল আমদানি করা হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তেল শোধনাগারগুলি। প্রযুক্তিগত, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য দিক বিচার করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” মনে করা যেতে পারে, গত ৮ তারিখ হিলারিকে পাশে নিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ যে সাংবাদিক বৈঠক করেন, তখনও ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কথা বলেননি তিনি।
গত সপ্তাহে মনমোহন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় হিলারি বিশেষ জোর দিয়েছিলেন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে তাঁদের আপত্তির প্রসঙ্গটিতে। পাকিস্তান প্রশ্নে পুরোপুরি ভাবে ভারতের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে তিনি স্পষ্ট করে দেন, তেহরানকে পরমাণু কর্মসূচি থেকে বিরত রাখতে নয়াদিল্লিকে ইতিবাচক ভূমিকায় দেখতে চায় ওয়াশিংটন। সেই সূত্রেই ইরান থেকে তেল আমদানি কমানোর অনুরোধ রাখেন তিনি। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, আজকের এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে চলেছে।
ভারত-আমেরিকার কৌশলগত সম্পর্ক এই মুহূর্তে যথেষ্ট টানটান হয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতবিরোধের কারণে। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে পরমাণু দায়বদ্ধতা বিল কোনও ক্ষেত্রেই নয়াদিল্লি এমন কোনও পদক্ষেপ সাম্প্রতিক কালে করতে পারেনি, যা খুশি করতে পারে হোয়াইট হাউসকে। সম্পর্কের এই স্পর্শকাতর সময়ে এই ‘ইরান তাসটি’ খেলায় দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত ক্ষেত্রে ভারত কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেতে পারে বলে আশা করছে সাউথ ব্লক।
পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদ পাচার, সীমান্তে ছায়া-যুদ্ধ, মুম্বই হামলার প্রধান অভিযুক্ত হাফিজ সইদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে ভারতের ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা করা এই সব বিষয় নিয়েই ঢালাও আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন হিলারি। কূটনৈতিক ভাবে এগুলি ভারতের কাছে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য এই সব আশ্বাসের পাশাপাশি হিলারি এই কথাও বলে গিয়েছেন যে, নিষেধাজ্ঞার চাপেই ইরান পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। এই চাপ বজায় রাখতেই ভারতের উচিত ইরান থেকে তেল আমদানি কমানো। দিল্লিকে সতর্ক করে হিলারি এমনও বলেন যে, “ভারত হয়তো মনে করে ইরান অনেক দূরে। তাই তার স্বার্থ সরাসরি বিঘ্নিত হচ্ছে না। কিন্তু মনে রাখবেন, ইরান এ দেশেও জঙ্গি পাঠিয়ে ইজরায়েলের কূটনীতিকদের উপর হামলা চালিয়েছে।”
বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, হিলারির সঙ্গে বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ জানান, গত এক বছর ধরেই পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে তেল আমদানির জন্য সক্রিয়তা বাড়িয়েছে ভারত। তবে হিলারিকে তিনি এটাও বুঝিয়ে দেন যে, বর্তমানে মোট আমদানির ১২ শতাংশ তেল আসে ইরান থেকে। এটা গত কয়েক বছরের তুলনায় কম হলেও এক ধাক্কায় ইরান থেকে তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয় ভারতের পক্ষে। কারণ, জ্বালানি ক্ষেত্রে ভারতের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। তাই যা করার, করতে হবে ধীরে ধীরে। তবে সরকারের আজকের এই ঘোষণায় স্পষ্ট, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তেল-কূটনীতিতে নিঃশব্দে অনেকটাই এগিয়েছে ভারত। তারই সুবাদে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ আজ রাজ্যসভায় ইরান থেকে তেল আমদানি কমানোর কথা ঘোষণা করতে পেরেছেন। |