ইস্টবেঙ্গল ৬ (টোলগে হ্যাটট্রিক-সহ ৪, লেন, পেন)
মহমেডান ০
|
কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কোনও উৎসবই হল না ইস্টবেঙ্গলে!
তীব্র উত্তেজক পরিস্থিতির মধ্যেও মহমেডানকে হাফ ডজন গোল। শিলিগুড়িতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের ০-২ হার। জোড়া সুখের পরও, জোড়া ধাক্কায় নজিরবিহীনভাবে থমথমে হয়ে রইল লাল-হলুদের ড্রেসিংরুম!
সোমবার খেলার শেষে টোলগে ওজবে এবং ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের ‘প্রস্থানে’ টালমাটাল অবস্থা মশাল ব্রিগেডের অন্দরে। টোলগের ধাক্কাটা প্রত্যাশিত ছিলই। তিনি এ দিন রাতেই উঠে পড়েছেন পৌলতোলা নৌকোয়। কিন্তু নাটকীয়ভাবে কোচের পদত্যাগ ঘোষণায় হতবাক কর্তারা। খেলা শেষের পর দীর্ঘক্ষণ ড্রেসিংরুমে বসে রইলেন তাঁরা। দরজা বন্ধ করে।
খেলার শুরুতে অবশ্য পরিবেশ ছিল একেবারে অন্যরকম। তীব্র গরম আর আর্দ্রতায় হাঁসফাঁস করছে শহর। দাবদাহে পুড়ছে চরাচর। চূড়ান্ত অপেশাদার আই এফ এ তার মধ্যেই দুপুরে খেলা ফেলেছিল। তা সত্ত্বেও আশা এবং আশঙ্কায় দুলতে থাকা হাজার দশেক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এসেছিলেন যুবভারতীতে। চোখের সামনে প্রিয় দলের ম্যাচ চাক্ষুস করার পাশাপাশি তাদের মন পড়েছিল শিলিগুড়িতে। মোহনবাগান-প্রয়াগ ম্যাচে। কারণ লিগ টেবিলে দুই প্রধানের পয়েন্টের ব্যবধান ছিল ১।
টোলগের প্রথম গোলের আগেই সুব্রত ভট্টাচার্যের মোহনবাগান গোল হজম করল। খবরটা যুবভারতীতে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই উচ্ছ্বাসে মাতল গ্যালারি। লাল-হলুদ পতাকা নিয়ে শুরু হল গ্যালারিতে দৌড়। জ্বলতে শুরু করল মশাল। ফাটতে লাগল বাজি। হাওয়ায় উড়তে শুরু করল লাল আবির। সদস্য-সমর্থকদের সেলিব্রেশনে কোনও ঘাটতি না থাকলেও কর্তাদের মুখ ছিল থমথমে।
একের পর এক গোল করছিলেন টোলগে। কোনওটা পেনের পাশ ধরে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায়। কোনওটা লেন বা নির্মলের থেকে বল পেয়ে তীব্র শর্পিল গতিতে বিপক্ষ বক্সে ঢুকে। কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এর আগে লাল-হলুদ জার্সিতে যত গোল করেছেন টোলগে, তাতবারই দেখা গিয়েছে তাকে নিয়ে উৎসবে মেতে উঠেছেন পেন, রবিন, ওপারারা। কিন্তু এ দিন দেখা গিয়েছে উল্টো ছবি। গোলের পর, এমনকী হ্যাটট্রিকের পরও সতীর্থরা কেউ ছুটে আসেননি তাঁর দিকে। ম্যাচের মধ্যেই ‘আমরা-ওরা’-র বিভেদ ফুটে উঠেছে বারবার।
গোল করে টোলগে একাই ছুটে গিয়েছেন গ্যালারির দিকে। চুমু ছুঁড়েছেন। সমর্থকদের উচ্ছ্বাসের উত্তাপ নিয়েছেন। তারপর ফিরে নিজেই গিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। খেলার শেষেও পুরো ইস্টবেঙ্গল টিম ড্রেসিংরুমে চলে গেল টোলগেকে ফেলে রেখে। এমনকী কর্তারাও। একমাত্র ম্যানেজার স্বপন বল দাঁড়িয়েছিলেন টানেলের গেটে। রেলিং টপকে পিলপিল করে মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন হাজার হাজার সমর্থক। তাদের উচ্ছ্বাসের আতিশয্যের মাঝখানে পড়ে ম্যাচের পর টোলগের সে কি অসহনীয় অবস্থা! কেউ হাত ধরে টানছেন, কেউ ঘাড়ে উঠে পড়ছেন, কেউ জার্সি ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত লাঠি চালিয়ে পুলিশ ড্রেসিংরুমে পৌঁছে দেয় জয়ের অন্যতম নায়ককে।
ভি ভি আই পি বক্সে বান্ধবী সুজানের ক্যামেরায় অবশ্য বন্দি থাকল সব ঘটনাই। টোলগের সব ছবি। চার চারটে গোলের। পাখির মতো দু’হাত বাড়িয়ে সেলিব্রেশনের। ম্যাচের পর পুলিশের ধাক্কা খেয়ে বিরক্ত সুজান বলছিলেন টোলগেকে, “তোমাকে এভাবে মাঠের মধ্যে সবাই ছেড়ে এল কেন?” ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুম ছেড়ে টানেল দিয়ে বেরিয়ে মোহনবাগানের গাড়িতে ওঠার সময় দেখা গেল সতীর্থদের মধ্যে পাশে শুধু পেন ওরজি। যিনি এ দিনই আবার বলে দিয়েছেন, “টোলগেকে প্রচণ্ড মিস করব। এতদিন জানতাম সামনে টোলগে আছে, পাস বাড়ালে গোল হবেই। পেশাদার জগৎ। এখানে সব কিছুই হয়।”
লিগ নিয়ে যতই উত্তেজনা থাক, মহমেডান যে কোনও প্রতিরোধ গড়তে পারবে না জানাই ছিল। এক বিদেশি নিয়ে অলোক মুখোপাধ্যায়ের দলের লজ্জাজনক হার হয়েছে ফুটবলের স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু যেটা বলার তা হল, এই ম্যাচ খেলব না, ঘোষণা করেও কেন ভাঙাচোরা দল নিয়ে খেলতে রাজি হল সাদা-কালো শিবির? আর যদি রাজিই হল তা হলে কেন ছেড়ে দেওয়া দুই বিদেশি স্ট্যানলি আর হাসানকে খেলানোর কোনও চেষ্টা করলেন না ক্লাব কর্তারা? মহমেডান যে আছে মহমেডানেই তা আরও একবার দেখিয়ে দিল এই ম্যাচ।
নানা নাটক এবং নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে তেত্রিশ বার লিগ জেতার দুর্লভ সম্মান পেল ইস্টবেঙ্গল। এবং মহমেডানের বিরুদ্ধে ক্লাবের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবধানে জিতে। দুটো ঘরোয়া ট্রফিই মর্গ্যানের পকেটে।
টোলগে দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কলকাতা লিগ জয়ের হ্যাটট্রিক করতে মর্গ্যান কি ফিরবেন পুরানো টিমে? আপাতত এটাই এখন চর্চার প্রধান বিষয় ময়দানে। অন্তত যতদিন না দেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরছেন লাল-হলুদের ব্রিটিশ কোচ।
|
ইস্টবেঙ্গল: সন্দীপ, নির্মল (সৈকত), ওপারা, রাজু, রবার্ট, মেহতাব, পেন, খাবরা (সঞ্জু), লেনস রবিন, টোলগে (বলিজিৎ)। |