প্রবন্ধ ২...
বাদ পড়ল তাঁর বিজ্ঞানচেতনা
বিগুরুর সার্ধশততম উৎসব শেষ। কবিতা, গান, নৃত্য-নাটক, কি নাটক, চিত্রকলা সাড়ম্বরে আমরা তুলে ধরেছি মানুষের কাছে। রবীন্দ্রসংগীতের মূর্ছনায় এখনও সমাজ সংসার মুখর। নৃত্যনাট্যের ছন্দ আমাদের অসীমে পৌঁছে দিয়েছে, তাঁর চিত্রকলার মাধ্যমে অজানার বিচিত্র সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। রবি ঠাকুরের প্রতি যে বাঙালির প্রাণের টান, তার শুরু আছে, শেষ নেই।
কিন্তু এই আনন্দোৎসবে কোথায় যেন ফাঁক থেকে গেল। বারো বছর বয়সে বালক রবীন্দ্রনাথ, পিতৃদেব মহর্ষির সঙ্গে ডালহৌসি পাহাড়ে গিয়েছিলেন। ডাকবাংলোর আঙিনায় সন্ধ্যাবেলায় চৌকি টেনে এনে মহর্ষি বালক রবিকে গ্রহনক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন। গিরিশৃঙ্গের ওপরে নিবিড় আকাশে তারাগুলি জ্বলজ্বল করত। মহর্ষি শুধু চিনিয়ে দিতেন না, দূরত্ব, প্রদক্ষিণের সময়, সব বুঝিয়ে দিতেন।
বালকের মনে গভীর দাগ কেটেছিল এই অভিজ্ঞতা। কাঁচা বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়, ১৮৭৪ সালে: ‘গ্রহগণ জীবের আকাশভূমি’। বিষয় তারামণ্ডলী এবং মহাকাশ। কবি তখন উৎসাহ নিয়েই বলেছিলেন, ‘স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম’। শুরু হল দুই পথের এক বেণীবন্ধন। যাত্রাপথের এক দিকে সাহিত্যসম্ভার, অন্য দিকে বিজ্ঞানের এক বিচিত্র অভিযান। সাহিত্য জোগান দিল বিজ্ঞানের স্বচ্ছন্দ গতিতে, আবার অন্য দিকে বিজ্ঞানের দুঃসাহসী উৎসাহ ‘জানার মাঝে অজানাকে’ আবিষ্কার থেকেই সাহিত্য পেয়েছে এক দুর্লভ প্রাণশক্তি। ‘প্রথম দিনের সূর্য’ অস্ত যাওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কবির এই অভিযান ছিল প্রাণময় ও সজীব।
দুই মন, দুই দৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন
রবীন্দ্রসংগীত আমাদের বড় প্রিয়। গানের সুর কথাগুলির অসীম গাম্ভীর্য এবং সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে প্রাণ ভরিয়ে দেয়। কিন্তু খুবই একটি পরিচিত গান ধরুন, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ...’ বিদ্রোহী পরমাণুই হল প্রাণ, আর আকাশ ভরা সূর্য তারা ওই ডালহৌসিতে নীল আকাশের তারাগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান’ সেইটাই তো বিজ্ঞানের গভীরতম সারমর্ম। গানের বিচিত্র লহরী তরতরিয়ে বয়ে চলেছে। কথাগুলির গভীর তাৎপর্য আর বিচিত্র সৌন্দর্য আমাদের এড়িয়ে যায়। গানই তো ভাল। গায়করা ‘ভুবন দোলে’ কথাটি এক বারই উচ্চারণ করে ছেড়ে দেন। আশ্চর্য, আধুনিক বিজ্ঞানের আধুনিকতম তত্ত্বকথায় বলা যেতে পারে, সত্যিই ‘ভুবন দোলে’, এক ভুবন শেষ হলে, সেই ধ্বংসের জন্ম থেকেই আবার নূতন ভুবনের শুরু। তাই তো বলছেন বন্ধুবর অধ্যাপক রজার পেনরোজ। কাজেই, রবীন্দ্রসংগীত কেবল মাত্র সংগীতই নয়, সংগীতের গভীরে বিজ্ঞানের যে নিপুণ নৃত্যনাট্য, সেই সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকে বেজে আসছে। শুধু সংগীত নয়, সংগীতের গভীরে বিজ্ঞান, আর বিজ্ঞানের গভীরে দর্শন।
১৯৩৮ সালে কবি ‘বিশ্বপরিচয়’ বইখানি লেখেন মৃত্যুর তিন বছর আগে। কনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে বইটি উৎসর্গ করেছিলেন। সেখানে লিখছেন, ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক।’
বিশ্বপরিচয়-এর ভূমিকায় বালক রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা সীতানাথ দত্ত মহাশয় জল গরম করে কাঠের গুঁড়োকে নীচ থেকে উপরে পরীক্ষা করে যখন দেখালেন, বালক রবীন্দ্রনাথের মন ‘বিস্ফারিত’ হয়েছিল। অনাবদ্ধ জলে একই কালে যে উপর নীচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে, সেই স্মৃতি বালক কবির মনকে এমনই আকৃষ্ট করেছিল যে সুদূর শৈশবের ওই পরীক্ষার স্মৃতি তিনি বিশ্বপরিচয়ে লিপিবদ্ধ করলেন।
জগদীশচন্দ্রের প্রতি তিনি গভীর ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। খুবই স্বাভাবিক। সেই মহাবিস্ময়, যে বিস্ময়ে ‘জাগে আমার প্রাণ’। মূল কথা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের পৃথক প্রকোষ্ঠের দরজা ছিল খোলা, ‘সেই জন্য আমাদের বন্ধুত্বের কক্ষে হাওয়া চলত দুই দিকের ওই খোলা জানলা দিয়ে।’
আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথের যে তর্কযুদ্ধটির কথা স্মরণ করুন। কবি অখণ্ড বাস্তব জগতের মানুষ, আর আইনস্টাইনের বহুবাদী চেতনার অখণ্ড বাস্তবের সঙ্গে বার-বার সংঘাত লেগেছে। আলোচনা তাই দু’দিকে ছুটেছে। কিন্তু এ কালের সবচেয়ে কঠিন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা কবির মতের দিকেই চলেছে তাঁর দর্শনে বিজ্ঞান যেন সায় দিয়েছে।
‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর...’। অসীম ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেই পরমাণু লুকিয়ে আছে। সেই পরমাণুই কি বিদ্রোহী, সে-ই কি সীমার মাঝে অসীম? ওই অসংখ্য পরমাণুই তো অসীম ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করেছে। নাচ-গান-ছবি-কলা-নাটকে, আনন্দে, নৃত্যের তালে তালে আমরা কবিকে উপলব্ধি করছি। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের যে গভীর চিন্তা বিজ্ঞানকে নিয়ে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, সেই বিজ্ঞানচেতনার উৎসব কোথায়? সেই চেতনার গভীরে যে আনন্দরস, তার হদিশ কে দেবে?
তাই বলছি, সার্ধশতবর্ষে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.