এগারো শতাংশেরও কম ছাত্রছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিকে পদার্থবিজ্ঞান পড়ে। জীববিজ্ঞান পড়ে সাড়ে চৌদ্দো শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গে যত উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে, তার প্রায় ৬০ শতাংশে বিজ্ঞান শাখায় পড়ার কোনও সুযোগই নেই। লিখছেন অশোকেন্দু সেনগুপ্ত |
প্রায় দুই দশক আগের কথা। হিমাচল প্রদেশের পালামপুর থেকে ফেরার সময় গণেশের দুগ্ধপানের গল্প কানে এল। সারা ভারত সেই রটনায় মেতে উঠেছে! পশ্চিমবঙ্গও। এই সেই বাংলা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ-জগদীশচন্দ্র-প্রফুল্লচন্দ্র-রামেন্দ্রসুন্দর-সত্যেন্দ্রনাথের দল উন্নত ব্যক্তি ও সমাজ গঠনে বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব বোঝাতে তাঁদের লেখা ও তাঁদের কর্ম দিয়ে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের প্রিয় কর্মভূমি বাংলা ক্রমে বিজ্ঞান ও যুক্তির পথ ছেড়ে নিমজ্জিত হয়েছে কুসংস্কারে। আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকারের দিকে যাত্রা। কেন? শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানের প্রতি অবহেলা একটা বড় কারণ।
সন্ধ্যায় পাঠানকোটে পৌঁছে খবর পেলাম দেশ গুজবমুক্ত হয়েছে এবং সেই গুজবকে পরাস্ত করায় কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে আকাশবাণী ও দূরদর্শন। আশ্বস্ত হলাম। বিজ্ঞান গুজবের পালে হাওয়া জোগাতেও পারে, গুজবের আগুন নেভাতেও পারে।
দেশ এখন অনেক এগিয়েছে। শিক্ষা বিস্তারের অভিযান বহু পথ পার হয়ে এসেছে। স্বাধীনতার কালে যে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৮ শতাংশ, সে দেশে এখন প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ সাক্ষর। কম নয়। কিন্তু সাক্ষরতাই কি শিক্ষা? সাক্ষরতা বাড়লেও বাড়েনি মুক্তচিন্তার পরিসর। প্রকৃত সত্য উন্মোচনে, তথ্য আর যুক্তিকে প্রশ্ন করতে চাই বিদ্যার আলো। কেমন আর কোন শিক্ষা আমাদের আলো দেখাতে পারে?
ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার পরিসর গড়ে তোলার উপযুক্ত শিক্ষা চাই। নিত্য দিনের অভিজ্ঞতাই বলে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সম্পর্কে আরও কিছুটা এবং আরও কিছুটা জানতে পারলে ভাল হয়। জানাটা শুরু হবে কোথা থেকে? বিদ্যালয় ব্যবস্থা থেকে শুরু করলেই তো ভাল। কোঠারি কমিশন বহু আগেই জানিয়েছিল: সাধারণ বিদ্যালয়শিক্ষার শেষ ধাপ পর্যন্ত বিজ্ঞান ও অঙ্কচর্চা শিক্ষা কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে হবে। |
এই রাজ্যে বাস করা মানুষের স্বার্থে বিজ্ঞানশিক্ষার আয়োজন কেমন, এই প্রশ্নটা তাই সামনে রাখছি।
পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কিত সর্বশিক্ষা অভিযানের পঞ্চদশ যৌথ পর্যালোচনা সংস্থা বলছে, ‘...যে সব বিদ্যালয় আমরা পরিদর্শন করেছি, তার প্রায় কোথায়ও, উচ্চ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে, কোনও বিজ্ঞান বা অঙ্কের স্নাতক দেখিনি। আর, সেই সব বিদ্যালয়ের একটিতেও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শাখা নেই’। অথচ নিয়ম ছিল, উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকদের ৫০ শতাংশ হতে হবে বিজ্ঞানের স্নাতক। উচ্চ প্রাথমিক স্তরে বিজ্ঞানশিক্ষায় এমন অবহেলার প্রভাব পড়েছে উচ্চতর স্তরে। রাজ্যে বিজ্ঞান-স্নাতক কমে চলেছে।
এই রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৬৫৩, এর মধ্যে ১৭৬৬টি (৩৮%) বিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান ও ১৯৭৩টি (৪২%) বিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ আছে। যে সব জেলায় বিশুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ ২৫%-এর কম, সেগুলি হল কোচবিহার (১৫.২%), দার্জিলিং (১৫.৭%), দক্ষিণ দিনাজপুর (২০.৭%), মালদহ (২৩.৩%), উত্তর দিনাজপুর (১৩.৯%)। জীববিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগে পিছিয়ে থাকা চারটি জেলার নাম কোচবিহার (১৬.৬%), দক্ষিণ দিনাজপুর (২২%), মালদহ (২৫.৩%), উত্তর দিনাজপুর (১৮.৩)। তুলনায় অবস্থা ভাল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার (বিশুদ্ধ বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৫৫.৪% ও ৬০%)। এই তথ্য এবং পরে উল্লেখিত আরও কিছু তথ্য থেকে আরও একটি নির্মম সত্য স্পষ্ট হয়, স্পষ্ট হয় উত্তরবঙ্গের প্রতি রাষ্ট্রের চরম অবহেলা।
উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ স্পষ্ট বলতে পারে না উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা। আমরা তাই ঘুরপথে একটা হিসেব করেছি। দেখছি, যে সব শিক্ষার্থী পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠরত, তারা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১০.৮%, আর জীববিজ্ঞান বিষয়ে নথিভুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ১৪.৩%। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীর সংখ্যায় পিছিয়ে থাকা তিনটি জেলার নাম জলপাইগুড়ি (৪.৫%), কোচবিহার (৪.২%) ও দক্ষিণ দিনাজপুর (৪.৭%)। জীববিজ্ঞান বিষয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীর সংখ্যার নিরিখেও সবচেয়ে পিছিয়ে আছে এই তিন জেলা।
হিসেবগুলি টাটকা, ২০১১ সালের। নানা ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যের সঙ্গে তুলনা হয় কেরলের। প্রায় এক দশক আগেই কেরলের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর ৪২.৭%।
পশ্চিমবঙ্গের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার্থী সংখ্যার যে হিসেব রাজ্য উচ্চশিক্ষা দফতরের ২০০৯-১০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, তা জানাচ্ছে যে, ওই স্তরে রাজ্যের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪% রয়েছে বিজ্ঞান শাখায়। গত এক দশকের ছবিটা প্রায় একই রকম। কারিগরি শাখার শিক্ষার্থীর সংখ্যা যোগ করে দেখলে দেখা যায় পরিমাণটা ২০-২১% মাত্র। ২০০৪ সালে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকনোমিক রিসার্চ’ প্রকাশিত ইন্ডিয়া সায়েন্স রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, তখন স্নাতকস্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর জাতীয় গড় প্রায় ২৫%।
কেন এই পিছিয়ে থাকা? বিজ্ঞানশিক্ষার আয়োজনে নাকি খরচ বেশি। সত্যি কি তাই? ভবতোষ দত্ত কমিশন লিখেছে: ‘অর্থাভাব বা জবরদস্ত লেবরেটরির অভাব বড় সমস্যা নয়। জ্যামিতি বাক্স, কিছু বাটখারা, পেন্ডুলাম, কয়েকটা লেন্স, প্রিজম, কিছু তার, ব্যাটারি ও বাল্ব, মডেল আর চার্ট এই হলেই তো যথেষ্ট। আর পুকুর, গাছপালা, ফুলফল, পশু, পাখি, পোকামাকড়, বৃষ্টি, আকাশ প্রকৃতির লেবরেটরি তো সর্বত্র’ (পৃ: ১৪৭)। আরও অনেক রকম ব্যবস্থা রয়েছে, যার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে এবং প্রায় নিখরচায়। ব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকান সেন্টার এবং আরও কিছু সংস্থা ও সংগঠন বিজ্ঞানশিক্ষাকে সরল ও আকর্ষণীয় করে তুলতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। যেমন বিষয়ভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি। জ্যোতিষীদের ধোঁকা বা অলৌকিক কাণ্ডকারখানা বা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষের যুক্তিবুদ্ধিকে শাণিত করে তুলতে বিজ্ঞানশিক্ষার আয়োজন বহুবিস্তৃত করতেই হবে, কোনও অজুহাতেই তা ফেলে রাখা যে চলবে না তা আমরা মানি, কিন্তু...।
বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে শিক্ষকের। স্কুলে স্কুলে বিজ্ঞানশিক্ষক থাকলেই যে বিজ্ঞানশিক্ষা তরতরিয়ে এগোত, এমন নয়। বিজ্ঞাপন দিয়ে ভাল ভাল ভেন্ডার পাওয়া যেতে পারে, ভাল শিক্ষক পাওয়া যায় না। শিক্ষকের হাতেই যদি পাঁচটা পাথর আর তাবিজ ঝোলে, যদি তার চেতনায় বিজ্ঞানের আসন পাতা না থাকে, তবে সে শিক্ষক নিছক এক খুচরো মাল-বেচা দোকানদার হয়ে ওঠেন, বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্য তাতে ব্যর্থ হয়। বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীর কৌতূহলটা খুঁচিয়ে গনগনে করে তুলতে পারেন বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষকই। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও নয়। বিজ্ঞান প্রদর্শনী, বিজ্ঞানমেলা, বিজ্ঞানভিত্তিক নানা মজার খেলা ও ধাঁধা এ সবই শিক্ষার্থীকে কাছে টানে যে তা সকলের জানা। কিন্তু জানলেই তো হবে না। শিক্ষকের উদ্যম চাই, উৎসাহ চাই। আর তার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকেও তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। অর্থাভাবে পীড়িত হয়ে গুটিয়ে থাকলে যেমন চলবে না, তেমন অর্থবরাদ্দ করে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করলেও কাজের কাজ কিছু হবে না। মুশকিল এই যে, পিছিয়ে যে আছি, সেই কথাটাই যে কারও নজরে বা বিবেচনায় আছে তা তো মনে হয় না।
কাজের কাজ কিছু করতে হবে। নইলে আমরা, বিশেষত এই রাজ্যের মানুষ, অনেক পিছিয়ে পড়েছি, আরও পিছিয়ে পড়তে হবে। যদি সতর্ক না হই, তবে অচিরেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ঘোড়ায় টানা উন্নয়নের রথের চাকায় পিষ্ট হবে মানুষ ও মানবসমাজ। একদা যে ভূখণ্ড অ্যাডাম স্মিথের ভাষায় ছিল ‘সমৃদ্ধিশালী দেশ’, তা এখন ক্ষুধা, হিংসা, নৈরাজ্যের দেশ। উত্তরণের জন্য যুক্তি-চৈতন্যের উদ্বোধন জরুরি হয়ে উঠেছে। |