এমনটাই ভাবেন এ রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ। অথচ পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রচারের
জন্য
নানা সরকারি দফতরে পড়ে রয়েছে কয়েকশো কোটি টাকা। লিখছেন স্বাতী ভট্টাচার্য |
সাধারণ পরিচ্ছন্নতার নিয়মগুলো ছাত্ররা কতটা জানে, কতটা পালন করে, তা বুঝতে বীরভূমের কয়েকটি স্কুলে একটা সমীক্ষা হয়েছিল গত বছরের শেষে। সর্বশিক্ষা মিশনের অনুদানে ‘আশা’ সংস্থার এই সমীক্ষায় পাঁচশোর উপর ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তাদের বয়স ছয় থেকে ১১ বছর। তাদের মধ্যে তফসিলি জাতি-জনজাতির ছাত্ররাও ছিল বেশ কিছু।
প্রাথমিক ফলাফল দেখে আঁতকে উঠতে হয়। দশ জনে আট জনই রাতে খাবার পরে দাঁত মাজে না, অর্ধেকেরও বেশি শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। বড় হতে হতে যে তারা যে এগুলো শিখে যাচ্ছে, এমনও নয় দেখা যাচ্ছে, দশ-এগারো বছরের ছেলেমেয়েদের ৮৪ শতাংশ খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। কোনও কোনও বিষয়ে খানিক উন্নতি হচ্ছে প্রাথমিকের তুলনায় উচ্চ প্রাথমিকে থুতু ফেলার মতো বদ অভ্যাস কমছে, কাশির সময়ে মুখের উপর হাত চাপা দেওয়ার ভাল অভ্যাস বাড়ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় দশ জনে চার জন ছেলেমেয়ের মধ্যে খারাপ অভ্যাসগুলো থেকেই যাচ্ছে।
এ তথ্য উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভারতের সামগ্রিক ছবিটাও এর কাছাকাছি। একটি বেসরকারি সংস্থার তৈরি ‘হাংগার অ্যান্ড ম্যালনিউট্রিশন রিপোর্ট’ (সংক্ষেপে ‘হাংগামা রিপোর্ট’) নয়টি রাজ্যের ১০০টি জেলায় সমীক্ষা করেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বাড়িতে সাবান আছে, কিন্তু শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছেন মাত্র ১৯ শতাংশ পরিবার, আর খাবার আগে ১০ শতাংশ। সাবানের দরকার স্নানের জন্য, এটাই চলতি ধারণা।
উদ্বেগ কিশোরী মেয়েদের নিয়েও। বীরভূমে দেখা যাচ্ছে, দশ জনে ছ’জনই ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে ‘ন্যাপকিন’ হিসেবে যা ব্যবহার করছে, তা দোকান থেকে কেনাই হোক বা বাড়িতে তৈরিই হোক, স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেকেই ব্যবহৃত জিনিসটি আবার ব্যবহার করছে, সংক্রমণের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় অনেক ছাত্রী মাসে চার-পাঁচ দিন স্কুলে যাচ্ছে না। |
এই তথ্যগুলো বীরভূমের, কিন্তু বাকি রাজ্যে ছবি খুব আলাদা নয়। তার একটা ইঙ্গিত ডায়ারিয়ার প্রকোপ। সরকারি হিসেবে, এ রাজ্যে প্রতি বছর অন্তত আড়াই লক্ষ মানুষ ডায়ারিয়ার জন্য সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারস্থ হন, মারা যান পাঁচশোরও বেশি। শিশুদের মধ্যে ডায়ারিয়ার প্রকোপ জাতীয় হারের চাইতে বেশি। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসলেই ৪২ শতাংশ কমে যায় ডায়ারিয়া। স্বাস্থ্য-অস্বাস্থ্যে এত সামান্য দূরত্ব, অথচ তা ঘোচানো আর যাচ্ছে না।
কেন এই সহজ উপায়গুলো মানা হচ্ছে না? এমন তো নয় যে, স্বাস্থ্যের কোনও নিয়মই মানছে না শিশুরা তারা রোজ সকালে দাঁত মাজে, প্রায় সকলেই নিয়মিত নখ কাটে, চোখ ধোয় পরিষ্কার জলে, পানীয় জল ঢাকা দিয়ে রাখে। এমনকী ১০-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ (২৯৪ জনের মধ্যে ২৫২ জন) জানিয়েছে, তারা নিয়মিত মশারি ব্যবহার করে। এই বার্তাগুলো তাদের কাছে কোনও না কোনও ভাবে পৌঁছে গিয়েছে। অথচ পৌঁছোয়নি রাতে দাঁত মাজা, কিংবা শৌচের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বার্তা।
অন্য দিকে, সুস্বাস্থ্যের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যার অনেকটাই খরচ হয় না। কোন প্রকল্পে বরাদ্দের কী দশা, এক বার তাকিয়ে দেখা যাক।
তথ্য ও সংস্কৃতি: জনস্বার্থমূলক বার্তাগুলি প্রচারের মূল দায়িত্বে রয়েছে যে দফতর। এই দফতরের দেওয়া হোর্ডিং কিংবা কাগজ-টিভির বিজ্ঞাপনের বাইরেও, মুখোমুখি আদানপ্রদানের মাধ্যমে প্রচারের জন্য বরাদ্দ থাকে টাকা। ২০০৯-১০ সালের জন্য ছিল ৩৮ লক্ষ টাকা, ২০১০-১১ সালের জন্য ৪০ লক্ষ টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রভৃতি নানা বিষয়ে এই টাকা খরচ হতে পারত। কিন্তু পর পর দু’বছর এই গোটা বরাদ্দই খরচ না হয়ে ফেরত চলে গিয়েছে। কী প্রকল্পে, কীসের প্রচারে খরচ হবে এই টাকা, তার পরিকল্পনা করে উঠতে পারেননি
দফতরের কর্তারা।
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন: এই দফতর পরিচালিত শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষা সহায়িকাদের প্রশিক্ষণের জন্য, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে মা ও শিশুদের শেখানোর জন্য ‘ফ্লিপ চার্ট’-এর জন্য, টাকা দেয় স্বাস্থ্য দফতর। ২০০৮-০৯ সালের বার্ষিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তিন কোটি ৮০ লক্ষ টাকার মধ্যে খরচ হয়নি দেড় কোটি টাকারও বেশি।
এ ছাড়া ‘টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন’-এর অধীনে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বদলের জন্য প্রচার করতে ২০০২ সাল থেকে এখনও অবধি মোট ১৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কেবল ‘Information, Education, Communication’ এর জন্য ধার্য এই টাকার মাত্র ২০ শতাংশ খরচ হয়েছে এ রাজ্যে। প্রতিটি জেলা বছরে এই বরাদ্দ থেকে দু’কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পায়। বীরভূম খরচ করেছে বরাদ্দের মাত্র ৬-৭ শতাংশ টাকা। ইউনিসেফ-এর এক প্রতিনিধি জানালেন, এর কারণ জেলাগুলোতে IEC র জন্য ভারপ্রাপ্ত কেউ নেই, স্থানীয় এন জি ও দিয়ে কাজ চালানো হয়। তারা কখনও ছৌ নাচ, কখনও বাউল গান, কখনও পথনাটিকা করে স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা প্রচার করছে। কিন্তু তাতে কাজ কতটা হচ্ছে, তার নজরদারি (‘মনিটরিং’) হচ্ছে না।
এই ছবির দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে, বরাদ্দ খরচ না হওয়ার সঙ্গে অসুস্থতার হারে বদল না হওয়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্তত খরচ না করলে যে শিশুরা সুস্থ থাকবে না, সেটা নিশ্চিত।
স্কুল শিক্ষা: সর্বশিক্ষা মিশন বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের (জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন, রাজীব গাঁধী পানীয় জল প্রকল্প প্রভৃতি) টাকা সমন্বিত করে পরিচ্ছন্নতার প্রচার করতে পারে, তাই টাকার অঙ্কটা নির্দিষ্ট নয়।
শিক্ষা-সম্পর্কিত প্রচার মিডিয়ার মাধ্যমে করার জন্য রাজ্য স্তরে দু’কোটি টাকা, এবং জেলাগুলির প্রতিটিতে প্রায় সমান পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করেছে সর্বশিক্ষা মিশন। এই টাকা থেকে ব্যয় হতে পারে সু-অভ্যাসের প্রচারের জন্যও। ‘লার্নিং এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর অধীনে বই-বহির্ভূত শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কাজের জন্য রাজ্যের হাতে গত বছর ছিল ১৩০ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও জেলায় জেলায় সর্বশিক্ষা মিশনের ‘প্রজেক্ট অফিস’ থেকে প্রকল্প রূপায়ণ বাবদ বরাদ্দ টাকার অনেকটাই স্কুলগুলির জন্য সাবান কেনা, এবং তার ব্যবহারের বিষয়ে প্রচারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সমাজ কল্যাণ দফতর: Information, Education, Communication-এর জন্য প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বছরে হাজার টাকা টাকা পায়।
টাকার অভাব নেই। তা হলে শিশুদের কুঅভ্যাস বদলাচ্ছে না কেন? কারণ তা নিয়ে কারও খুব মাথাব্যথা নেই। শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হল, তাঁদের তাগিদ দু’রকম। এক, স্কুলগুলোতে শৌচাগার তৈরি করা। ২০০৮ সাল অবধি নির্মাণের কাজই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। দুই, কিছু কার্যসূচি পালন করে যাওয়া। যেমন ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’-এর জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ৭-১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন, প্রভৃতি। কিন্তু শিশুদের দৈনন্দিন অভ্যাসের উপর নিয়মিত নজরদারির কোনও ব্যবস্থা নেই। বরং সর্বশিক্ষা মিশনের কর্তাদের মনোভাবটি এ রকম যে, ‘জানানো হচ্ছে যখন, শিশুরা তা করছে নিশ্চয়ই।’
কী ভাবে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বার্তা দিলে তাতে কাজ হবে, তা নিয়ে নানা পরীক্ষা হয়েছে। অমিতাভ বচ্চনকে কাজে লাগিয়ে পোলিয়ো টিকার জন্য ‘দো বুঁদ জিন্দেগি কা’ প্রচারটি কার্যকর হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভরসায় বিদ্যা বালনকে দিয়ে ‘নির্মল ভারত অভিযান’ শুরু করছে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রক। আবার সাধারণ মানুষ যাঁরা অভ্যাস পরিবর্তন করে ভাল ফল পেয়েছেন (‘পজিটিভ ডিভিয়ন্স’), তাঁদের সামনে রেখে প্রচার করে ফল মিলেছে পশ্চিমবঙ্গেই, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প দিয়ে অপুষ্টি মোকাবিলার ক্ষেত্রে। কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট দলে ভাগ করে কথাবার্তা বললে কাজ হয়, যেমন গর্ভবতীদের কাছে স্বাস্থ্যের কথা পৌঁছতে হলে। কোথাও এলাকার বাসিন্দাদের সার্বিক অংশগ্রহণ দ্রুত ফল দেয়, যেমন ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য জমা জল পরিষ্কার করা।
কোন কৌশল কাজ দেবে, ‘স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন’-এর সেই উপায়টি ঠাহর করা সহজ নয়। তা পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং সময় দাবি করে। সেই দাবিই করছে পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা। তাদের শিক্ষার অধিকারের মধ্যে পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অধিকার ঢোকানো অর্থহীন হয়ে যাবে যদি কেবল টয়লেট তৈরি করে, আর স্বাস্থ্য বিষয়ে বসে-আঁকো প্রতিযোগিতা করে দায় সারা হয়। যদি পরিকল্পনার অভাবে প্রচারের টাকা ফিরে যায়। স্কুলগুলোতে শৌচাগারও রয়েছে, মিড ডে মিলের খাওয়াদাওয়াও হচ্ছে, অথচ শিশুরা হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে পারছে না। অসুখ-অপুষ্টি-অশিক্ষার চক্র ভাঙছে না। এই একটি ব্যর্থতাই স্বাস্থ্য-শিক্ষা-তথ্য-পঞ্চায়েত-সমাজ কল্যাণ, সব দফতরকে ফেল করিয়ে দিচ্ছে।
ওই অ-ধোয়া হাতগুলোই এ রাজ্যে দারিদ্রের সূচক। |