মধ্যরাত্রে গঙ্গায় একটি ডিঙি নৌকা উল্টাইয়াছে। ক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী লইয়া পারাপার চলিতেছিল। পরিণামে এই দুর্ঘটনা। এই কাণ্ড পশ্চিমবঙ্গে, বস্তুত ভারতে, নজিরবিহীন কিছু নহে। কিছু প্রশ্ন তবু থাকিয়া যায়। যে রূপে ঘটনাটি ঘটিল, তাহা ভাবিয়া দেখিবার। জলযানে ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন প্রায়শই ঘটিয়া থাকে। কী ভাবে ঘটিয়া থাকে, তাহা প্রশাসনের অজানা নহে। কাহারা এই অপরাধের সহিত জড়িত, তাহাও জানা। জনৈক পুলিশকর্তা বলিয়াছেন, পূর্বের তুলনায় নজরদারি প্রচুর বাড়ানো হইয়াছে। ফলে, এই ধরনের যাত্রীবহন অনেক কমিয়াছে। তাঁহার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট রাত্রে কোনওক্রমে নৌকাটি নজর এড়াইয়া অপকর্ম চালাইতেছিল। ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য নহে। দুর্ঘটনার পরে পুলিশের টহলদার লঞ্চ-ই উদ্ধারকার্য শুরু করে। অর্থাৎ, সেই রাত্রে অকুস্থলের সন্নিকটে পুলিশি টহল ছিল। তৎসত্ত্বেও, কী রূপে ঘটনাটি ঘটিল, তাহার যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।
প্রশ্ন আরও। এই জাতীয় অপরাধে সরাসরি মানুষের প্রাণহানির শঙ্কা থাকে। ইহা জানা সত্ত্বেও কেন এই ধরনের অপরাধের প্রতি পরিভাষায় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা হইবে না? প্রশাসন জানে, বিশেষ কোন সময়ে এই ধরনের অপকর্ম অধিক মাত্রায় ঘটিয়া থাকে। দুর্ঘটনার রাত্রেও তেমনই একটি উপলক্ষ ছিল। স্থানীয় একটি ধর্মীয় পার্বণের সূত্রেই সেই পারাপার। সাধারণ যুক্তিই বলিবে, এই সময় টহলদারি আরও বেশি হইবার কথা। নজরদারি ছিল, তবু তাহাকে এড়াইয়া এমন একটি কাণ্ড ঘটিয়া গেল— ইহা পদ্ধতিগত শৈথিল্যের প্রতিই অঙ্গুলিনির্দেশ করে। এমন কাণ্ড চলিতে পারে না বলিয়া যদি সাব্যস্ত হয়, তাহা হইলে শৈথিল্যটি কেন? কেন-ই বা দায় ও দায়িত্ব লইয়া একাধিক বিভাগের ভিতর দড়ি টানাটানির প্রক্রিয়া?
উত্তরটি অজানা নহে। এক ধরনের গয়ংগচ্ছ মনোভঙ্গি কার্যত সর্বস্তরে বিদ্যমান। তাই একটি দুর্ঘটনা ঘটিবার পরে প্রশাসন তৎপর হয়। কালযাপনের সহিত সেই তৎপরতা ক্রমে কমিয়া আসে। অপকর্ম ফের চালু হয়। পুনরায় আর একটি দুর্ঘটনা ঘটিবার পরে প্রশাসনিক তৎপরতাও ফিরিয়া আসে। এই মর্মান্তিক কাণ্ডটি ঘটিবার পরে মৃতদের পরিবারের জন্য সরকারি তরফে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা হইয়াছে। যাঁহাদের স্বজনবিয়োগ ঘটিয়াছে, তাঁহাদের ক্ষতি অপূরণীয়। সেই বিচারে সরকারি সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সমবেদনার ছাপ বহন করে। সেই দিক হইতে এই সিদ্ধান্তের এক ধরনের তাৎপর্য খুঁজিয়া পাওয়া যায়। একটি ছোট্ট কথা থাকে তবু। বেআইনি যাত্রী পারাপার করিবার ফলে একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। তাহার জন্য নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান মানবিক দিক হইতে সদর্থক, নিঃসন্দেহে, কিন্তু প্রশাসনিক অর্থে? তর্ক উঠিতে পারে, সরকারের তরফে এমন একটি ঘোষণা, এক অর্থে, এই ধরনের কাণ্ডকে এক ধরনের বৈধতাই প্রদান করে নাকি? দুর্ঘটনা ঘটিবার পরে মানবিকতা জরুরি। দুর্ঘটনা রুখিবার লক্ষ্যে প্রশাসনিক তৎপরতা তাহা অপেক্ষাও অধিকতর প্রাসঙ্গিক। |