সম্পাদকীয় ১...
ছয় দশক পরে
ই পি এল আসিয়া যেমন ক্রিকেটকে লইয়া গেল, তেমনই ভারতে রাস্তার রাজনীতি প্রকৃত গণতন্ত্রকে লইয়া গিয়াছে। সংসদের ছয় দশক পূর্তির মুহূর্তে সুরটি, অতএব, অপ্রাপ্তির। গণতন্ত্রের যে আদর্শের অভিমুখে যাত্রারম্ভ হইয়াছিল, ছয় দশক পরে ভারতের অবস্থান সেই অভীষ্ট হইতে বহু দূরে। ক্রিকেটের ন্যায় ‘সংসদ’-এর ধারণাটিও ভারতীয় নহে, মূলত ব্রিটিশ। ভারতীয় গণতন্ত্রের ছয় দশক সেই ধারণাটির ভারতীয়করণের যে প্রচেষ্টা করিয়াছে, তাহার ফল বিষম হইয়াছে। গণতন্ত্রে রাস্তার রাজনীতির কোনও স্থান নাই। রাজনীতির একমাত্র স্বীকৃত পরিসর আইনসভা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেই পরিসরে বিতর্কের মাধ্যমে নীতি নির্ধারণ করিবেন। কেহ বলিতেই পারেন, তবে কি গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের স্থান নাই? তাঁহারা নিজেদের মতামত প্রকাশ করিবেন কোথায়? চণ্ডীমণ্ডপে অভ্যস্ত ভারতীয় সমাজ নিজের মতো করিয়া এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়া লহিয়াছে। কিন্তু, সেই উত্তরটি ভুল, তাহা সংসদীয় গণতন্ত্রের সংজ্ঞার পরিপন্থী। মানুষ যাঁহাদের নির্বাচিত করিয়া সংসদে পাঠান, তাঁহারাই মানুষের প্রতিনিধি। নির্বাচকমণ্ডলীর হইয়া কথা বলাই তাঁহাদের দায়িত্ব। নির্বাচকদের মত প্রকাশ করিতে হইলে তাঁহারা নাগরিক সমাজে বিতর্কের পরিসর সৃষ্টি করুন। যথার্থ পরিসর। অণ্ণা হজারে বা নিজের পুরাতন অবতারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজনীতির ব্যাপারী, সেই পরিসর নহে। বস্তুত, বন্ধ বা ভাঙচুরের রাজনীতির সহিত অণ্ণা হজারের রাজনীতির মধ্যে একটিই ফারাক প্রথমটি বে-আইনি, দ্বিতীয়টি নহে। কিন্তু উভয় রাজনীতিই অগণতান্ত্রিক। ষাট বৎসরেও সংসদীয় বিতর্কের ধারণাটি ভারতের মাটিতে শিকড় গাড়িতে পারিল না, তাহা অতীব দুঃখের।
ভারতে গণতন্ত্রের ধারণাটিকে বহু আঘাত সহিতে হইয়াছে, হইতেছে। দলতন্ত্রের প্রতিপত্তি তাহার একটি। ব্রিটেনে রাজনৈতিক দল আছে বটে, কিন্তু তাহার ভূমিকা অতি সীমিত, অতি সাময়িক। এক বার নির্বাচন হইয়া গেলে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদীয় দলটিই মূল। তাঁহারা সংসদে নিজেদের নেতা বাছিয়া লন। সেই নেতাই দলের নেতা রূপে গণ্য। তিনি অন্য নেতাদের বাছিয়া লন। সংসদীয় রাজনীতিতে এই সংসদীয় দলটির গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। এবং, তাহাই বিধেয়। ভারতীয় রাজনীতি এই ধারণাটিকে নিজের মতো মুড়িয়া লইয়াছে। এখানে দলই মুখ্য। সংসদে যিনি নেতা, বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়াছে, দলের নিয়ন্ত্রণ তাঁহার হস্তে নামমাত্রও নাই। সংসদের অভ্যন্তরেও দল পরিচালিত হইতেছে বাহিরের পার্টি অফিসের অঙ্গুলিনির্দেশে। এই দোষে সকল দলই দুষ্ট। ২৪ আকবর রোড যেমন এই নীতি মানিয়া চলিয়াছে, এ কে গোপালন ভবনও ব্যতিক্রম হয় নাই। আর, কলিকাতার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট হইতেও যে সংসদীয় দলের চলন নির্দিষ্ট হইতে পারে, তাহাও বারে বারেই প্রমাণিত। ইহা সংসদীয় রাজনীতির অবমাননা। ভারত যে ব্রিটিশ সংসদের কাঠামোটুকুই নকল করিয়াছে, তাহার আত্মাকে ছুঁইতেও পারে নাই, ইহা তাহার অলঙ্ঘ্য প্রমাণ।
প্রমাণ আরও আছে। সংসদীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে রহিয়াছে জনপ্রতিনিধিদের ‘নির্বাচিত’ হওয়া। যে রাজনীতিক মানুষের ভোট পাইতে ব্যর্থ হন, সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁহার স্থান হওয়ার যুক্তি নাই। কিন্তু, ভারতে আর সব বিষয়ের ন্যায় জনপ্রতিনিধিত্বেরও ‘পিছনের দরজা’ রহিয়াছে। তাহার নাম রাজ্যসভা। যে রাজনীতিক লোকসভা নির্বাচনে জিতিতে ব্যর্থ হন, তিনি রাজ্যসভার ঘুরপথে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করেন। ইন্দিরা গাঁধীর আমলে প্রণব মুখোপাধ্যায় এই পথেই দেশের অর্থমন্ত্রী হইয়াছিলেন। আরও বড় উদাহরণ মনমোহন সিংহ। যে রাজনীতিক লোকসভা ভোটে দাঁড়াইতেই সাহস করেন নাই, তিনি দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান ইহা গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ নহে। ভারতের দুর্ভাগ্য, সংসদের উচ্চতর কক্ষের ধারণাটি এই দেশের রাজনীতিকরা বুঝিতেই পারিলেন না। যে কক্ষ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রক্ষাকবচ হইতে পারিত, সংসদীয় রাজনীতিতে সমাজের বিশিষ্ট জনের প্রতিনিধিত্বের পরিসর হইতে পারিত, তাহা ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের গলিপথ হইয়া রহিল। দেশের সংসদের ছয় দশক পূর্তির মুহূর্তটি এই অক্ষমতার লজ্জায় কালিমালিপ্ত। আরও কত বৎসর অতিক্রান্ত হইলে ভারত গণতন্ত্রের ধারণায় প্রকৃত দীক্ষা পাইবে, তাহা ভবিষ্যৎই জানে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.