চোখে কালো রোদ-চশমা। তবে মুগ্ধতা তাতে আড়াল পড়েনি মোটে। ভাল লাগাটা প্রকাশ করলেন মুখেও, “চোখ জুড়িয়ে গেল! ইট ইজ আ ট্রিট ফর মি।” ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও তার চারপাশের সবুজ স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হিলারি ক্লিন্টন।
আগের সফরে ছিলেন আমেরিকার ‘ফার্স্ট লেডি’। এ বার বিদেশসচিব। রবিবার দুপুরে মার্কিন বায়ুসেনার বিশেষ বিমানে ঢাকা হয়ে কলকাতায় এসেছেন তিনি। প্রায় ১৫ বছর ৮ মাস পর। রবিবার দমদম বিমানবন্দর থেকে মার্কিন বিদেশসচিবের কনভয় পৌঁছয় দক্ষিণ কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে। আজ, সোমবার মহাকরণে গিয়ে দেখা করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দুপুরেই রওনা দেবেন নয়াদিল্লি। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হবে। রবিবার হোটেলে পৌঁছনোর কিছু পরে বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ হো চি মিন সরণিতে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস’ (আইসিসিআর) সংস্থার একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান হিলারি। তার পর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ঠাসা কর্মসূচিতে রাখাই ছিল ব্রিটিশ স্মৃতিসৌধ দর্শনের পর্বটুকু। |
বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিট। ২৪টি গাড়ির কনভয় নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের কালচে নীল টয়োটা ল্যান্ডক্রুজারে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পৌঁছন হিলারি। মুগ্ধতার রেশ স্পষ্ট ফুটে ওঠে তাঁর চোখ মুখে। স্মৃতিসৌধের গম্বুজের গঠন নিয়ে সাগ্রহে ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর স্বপন চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সংগ্রহশালাটিও ঘুরে দেখেন। বার কয়েক দাঁড়িয়ে পড়েন সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার ছবিগুলির সামনে। প্রদর্শশালা থেকে বেরিয়ে বাগানে পা রেখে মুগ্ধ হিলারি বলে ওঠেন, “.... ইট ইজ আ ট্রিট ফর মি।” ‘ট্রিট’ অবশ্য ভিক্টোরিয়ার সেই সব কর্মীদের কাছেও, যাঁদের ডেকে নিয়ে একসঙ্গে ছবি তুললেন মার্কিন বিদেশসচিব। হিলারির সফরসঙ্গীদেরও দেখা গেল কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর হাতে ক্যামেরা তুলে দিয়ে ভিক্টোরিয়ার সামনে নিজেদের ছবি তুলতে। মিনিট ২০ এখানে কাটিয়ে হিলারির কনভয় রওনা দেয় হোটেলের পথে। মার্কিন বিদেশসচিবের কনভয় ভিক্টোরিয়ার পৌঁছনোর আগে, ওই স্মৃতিসৌধের উত্তর দিকের প্রবেশপথের লোহার গেট খুলে দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশে ভিক্টোরিয়ায় গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ। সে জন্য বহু দিনের ‘অব্যবহৃত’ ওই গেট খুলতে গিয়ে বেশ খানিকটা কসরতই করতে হয় সেখানকার কর্মী ও পুলিশকে।
ব্যস্ত সফরসূচির জেরে আজ দিনভর একই পোশাকে দেখা গেল হিলারিকে। সাদা টি-শার্ট-এর উপরে সাদা বর্ডার দেওয়া কালো জ্যাকেট, কালো ট্রাউজার্স, কালো জুতো। গলায় সাদা-কালো মুক্তোর মালা, কানে মুক্তোরই দুল। রোদ এড়াতে বেশির ভাগ সময়ই চোখে ছিল কালো রোদ-চশমা।
এ দিন মার্কিন বিদেশসচিবের আসা নিয়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও কিছুটা উদ্বেগে পড়েছিলেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, ঢাকা থেকে তাঁর বিমান ছাড়ার কথা ছিল বেলা পৌনে বারোটায়। কিন্তু, বারোটা নাগাদও তাঁর বিমানের কোনও খবর না পেয়ে উদ্বিগ্ন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করেন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে। কলকাতার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) থেকে সরাসরি কথা বলা হয় ঢাকা এটিসি-র সঙ্গে। জানা যায়, হিলারির বিমান তখনও দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই।
দুপুর সওয়া বারোটায় সেই ‘বোয়িং ৭৫৭’ ঢাকার মাটি ছাড়ে। ১২টা ৪২ মিনিটে কলকাতার এটিসি-র রেডারে প্রথম ধরা পড়ে হিলারির বিমানের গতিবিধি। |
রবিবার বিকেলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে মিনিট কুড়ি ছিলেন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন।
বাগান দেখে মুগ্ধ হয়ে হিলারি বলেছেন, “ইট ইজ আ ট্রিট ফর মি।” ছবি: সুমন বল্লভ |
দুপুর ১২টা ৫২, কলকাতায় হিলারি। আন্তর্জাতিক বিল্ডিং লাগোয়া ‘সেরিমনিয়াল লাউঞ্জ’-এর সামনে ৪২ নম্বর বে-তে ওই বিমান এসে দাঁড়ানোর পরে হিলারি নেমে আসেন। হাত নাড়েন চিত্র-সাংবাদিকদের উদ্দেশে। তাঁর দলের এক অফিসার বিমানের ৩৯ জন যাত্রীর পাসপোর্ট তুলে দেন অভিবাসন অফিসারদের হাতে। জনাপাঁচেক অভিবাসন অফিসার স্ট্যাম্প নিয়ে হাজির ছিলেন সেরিমনিয়াল লাউঞ্জ-এই। সেখানেই যাবতীয় কাজকর্ম সেরে নেওয়া হয়। ছিলেন শুল্ক অফিসারেরাও। হিলারি ও তাঁর সঙ্গীরা কী কী নিয়ে এসেছেন, তার একটি তালিকা তুলে দেওয়া হয় শুল্ক অফিসারদের হাতে। বিমানে বেশ কিছু অস্ত্র রয়েছে। সেগুলি শুল্ক অফিসাররা ‘সিল’ করে দেন। হিলারির ১৭ জন দেহরক্ষী কী ধরনের অস্ত্র নিয়ে এসেছেন, তারও তালিকা তুলে দেওয়া হয়।
বিমান থেকে নামতেই মার্কিন বিদেশসচিবকে স্বাগত জানান রাজ্য সরকারের কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের সচিব ইন্দিবর পাণ্ডে। কলকাতায় মার্কিন কনসুলেটের এসইউভি-তে হোটেলের দিকে রওনা দেন হিলারি। বিমান পাহারার জন্য থেকে যান চার মার্কিন নিরাপত্তারক্ষী। এ দিন হিলারির পুরো যাত্রাপথই নিরাপত্তার মোড়কে মুড়ে ফেলেছিল কলকাতা পুলিশ। দক্ষিণ কলকাতার পাঁচতারা হোটেল, মার্কিন কনস্যুলেট অথবা ভিক্টোরিয়া সব জায়গাতেই হিলারির কনভয় পৌঁছনোর আগেই যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে তাঁর হোটেলে যাওয়ার রুটেও ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা-বলয়। কয়েক কদম দূরে-দূরে মোতায়েন ছিল পুলিশ। |
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে হিলারি ক্লিন্টন। ছবি: সুমন বল্লভ |
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের লাগোয়া ফুটপাথে দুপুর থেকেই সাধারণ মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত করা হয়। বন্ধ ছিল ওই চত্বরের সমস্ত দোকানপাট। ঘোড়ার গাড়িগুলিও সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে মার্কিন বিদেশসচিবের কনভয় ভিক্টোরিয়া থেকে বেরনোর মিনিট কয়েকের মধ্যেই ভিক্টোরিয়ার সামনে ফের ফেরে রবিবারের ‘চেনা ব্যস্ততা’র ছবি।
সোমবার লা মার্টিনিয়ার ফর গালর্স স্কুলে কলকাতার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের মুখোমুখি হবেন হিলারি। ওই স্কুলের অধ্যক্ষ এল মির্জা জানান, সোমবার সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ মার্কিন বিদেশসচিব তাঁদের স্কুলে যেতে পারেন বলে দূতাবাস সূত্রে জানানো হয়েছে। কোন কোন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করবেন? এল মির্জা বললেন, “মার্কিন দূতাবাসই তা ঠিক করেছে। প্রত্যেকটি স্কুল থেকে চার জন ছাত্র প্রতিনিধি এবং এক জন শিক্ষক সেখানে থাকবেন। আমাদের স্কুল থেকে প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলবেন দশ জন ছাত্রী ও এক জন শিক্ষিকা।” স্কুলের সভাঘরেই পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলবেন মার্কিন বিদেশসচিব। ঘণ্টাখানেক থাকতে পারেন সেখানে। |