বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে ‘নতুন অংশীদার’ করতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আগামিকাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা সেই অভিমুখেই নিয়ে যেতে চাইছেন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন। হিলারির সফরের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে আজ মমতাকে একটি চিঠি দিয়েছেন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল। সেই চিঠির শেষ অনুচ্ছেদে পাওয়েল লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গকে তাঁদের বিশেষ ‘পার্টনার’ বা অংশীদার হিসেবে দেখতে চান হিলারি। শুধু তাই নয়, হিলারির এই সফরের পিছনে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ব্যক্তিগত উৎসাহ রয়েছে, সে কথাও জানাতে ভোলেননি পাওয়েল। অন্য দিকে, রাজ্যে কী ভাবে মার্কিন লগ্নি আনা যায়, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে চান মমতা। তিনি অবশ্য জানিয়েছেন, আগে তিনি হিলারির বক্তব্য শুনবেন। তার পর জানাবেন, তাঁরা কী চান।
এত দিন মার্কিন প্রশাসনের প্রায় কোনও শীর্ষ নেতারই গন্তব্য ছিল না কলকাতা। এই প্রথম কোনও মার্কিন বিদেশসচিব এলেন কলকাতায়, যিনি বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। রাজ্যে পা দেওয়ার আগে হিলারি ক্লিন্টন জানিয়েছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের এক জন ‘ডায়নামিক’ নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। রাজধানীতে হিলারির অন্য বৈঠক থাকলেও তাই দিল্লিও তাঁর সঙ্গে মমতার বৈঠককে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কী বিষয়ে আলোচনা হবে আর কী বিষয়ে নয়, তা নিয়েও মমতার সঙ্গে পাওয়েলের আগাম কথা হয়েছে। নয়াদিল্লির কূটনীতিকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন পাওয়েল।
আগামিকালের বৈঠকটি নিয়ে মমতা বলেন, “হিলারি ক্লিন্টন এই বৈঠকটি করতে চেয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই প্রথমে তাঁর কলকাতায় আসার ইচ্ছের কথা জানানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সদর্থক সাড়া দিয়েছি। কাজেই উনি যখন আসতে চেয়েছেন এবং বৈঠক করছেন, তখন উনি কী বলতে চান, সেটা আমি প্রথমে শুনতে চাইব। তার পর আমরা কী চাই, সেটা পেশ করব।”
রাজ্য সরকার সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাজ্যে কী ভাবে মার্কিন লগ্নি আনা সম্ভব, মমতার পক্ষ থেকে তা নিয়ে আলোচনার উপরে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে মার্কিন বিনিয়োগ নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আসার আগেই সেটা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হইচই করতেও কিন্তু উৎসাহী নন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি তাঁর শীর্ষ অফিসারদের কাছে জানিয়েছেন, জ্যোতি বসু বহু বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ব্ল্যাকউইল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছেন। বুদ্ধবাবুর আমলে এসেছিলেন ট্রেজারি সেক্রেটারি হেনরি পলসনও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মার্কিন লগ্নি আসেনি। তাই এ বার উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে বাস্তববাদী হয়ে এগোতে চাইছেন মমতা।
হিলারি কিন্তু রাজ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মার্কিন বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। যদিও ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কটা দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রকে বাদ দিয়ে তাই কোনও অঙ্গরাজ্য সরসারি অন্য কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারে না। কিন্তু এ যাবৎ মার্কিন কর্তারা গুজরাত, কর্নাটকের মতো রাজ্যকে গুরুত্ব দিলেও কখনও পশ্চিমবঙ্গকে সেই গুরুত্বটা দেননি। এ বার যখন তাঁরা সেই গুরুত্বটা দিচ্ছেন, তখন তার ফায়দা তুলতে চাইছেন মমতা।
সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, হিলারি এক নতুন সিল্ক রুটের বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। এই সিল্ক রুটটা কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান, ভারত হয়ে বাংলাদেশ দিয়ে মায়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। নিরাপত্তাগত দিক থেকেও এই মুহূর্তে এই অঞ্চলটির গুরুত্ব অসীম। মমতা নিজে ‘লুক ইস্ট’ বা ‘পুবে তাকাও’ নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ, মায়ানমার-সহ অন্য রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সেতু রচনায় ইতিমধ্যেই ন্যান্সি পাওয়েলের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
ভারতে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি, জমি অধিগ্রহণ নীতির সংস্কারের মতো আর্থিক সংস্কারের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সুবিদিত। ভারতে শরিকি টানাপোড়েনের জেরে এই ধরনের বিল যে সংসদে পাশ হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, তাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুশি নয়। সেটা তারা একাধিকবার জানিয়েছে।
কিন্তু আগামিকাল যখন হিলারি-মমতা বৈঠক হবে, তখন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে কোনও ভাবেই নাক গলানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নয়। ইতিমধ্যেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করাটা হিলারির অনুচিত হবে। মমতাকে কিন্তু মার্কিন কর্তারা আগাম জানিয়ে দিয়েছেন, এই ধরনের কোনও অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতে আগ্রহীই নয়। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক যাতে মজবুত হয়, সে বিষয়ে তাঁরা উৎসাহী। তবে বাংলাদেশের দিক থেকে আমেরিকার উপরে চাপ আছে, যাতে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনও সমাধান সূত্রের জন্য তারা চেষ্টা করে। আমেরিকাও চায় এই নিয়ে জট খুলুক। সেটা এই অঞ্চলের
জন্যও ভাল। তবে এই নিয়ে কথা বলা মানে সেটা দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে নাক গলানো হয়ে যাবে বলে হিলারি সম্ভবত সরাসরি তিস্তার প্রসঙ্গ তুলবেন না। আবার মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর ফলে যদি বাংলাদেশে হাসিনার সরকার দুর্বল হয় এবং তার ফলে অদূর ভবিষ্যতে যদি সে দেশে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দেয়, তা হলে সেটা ভারতের জন্য তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের জন্যও ভাল হবে না।
এ বিষয়ে মমতা কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত। তিনি কেন্দ্রকে জানিয়েছেন, তিনি চুক্তির বিরুদ্ধে নন, হাসিনারও বিরোধী নন। চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দেখা হলে তাঁর আপত্তি নেই। তিনি আরও মনে করেন, বুদ্ধবাবুর জমানায় যে রকম মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে জঙ্গি-হানা হয়েছিল, এর পরে যাতে তেমন কিছু না ঘটে, সে জন্য সব দিক থেকে রাজ্য সরকারকে সতর্ক থাকতেই হবে। হাসিনা-সরকারের সহযোগিতায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে এখন জঙ্গি-অনুপ্রবেশ অনেকটাই বন্ধ রয়েছে। অনুপ্রবেশ বাড়লে এবং তার ফলে পশ্চিমবঙ্গে তালিবান-আইএসআইয়ের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলে সেটা হবে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ (ক’দিন আগেই মমতার সঙ্গে দেখা করে ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন)। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী দাবি তুলেছিল, যেন হিলারির সঙ্গে মমতার বৈঠকটি না হয়। মমতা এই গোষ্ঠীর অভিমত গ্রাহ্য করেনি। আগামিকাল বৈঠকের পর দু’জনেই মহাকরণে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার কথা। তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, টেলি-যোগাযোগ এবং কৃষি, এই সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লগ্নি করছে। পরিবেশ ক্ষেত্রেও আমেরিকা যৌথ ভাবে কিছু করতে উৎসাহী। পশ্চিমবঙ্গে পুনর্নবীকরণ শক্তি, শিক্ষা ও চিকিৎসা সরঞ্জামে লগ্নির আগ্রহ রয়েছে। |