রবীন্দ্রনাথকে সেতু করে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী আজ এক নতুন গতি পেল। কবির জন্মের সার্ধশতবর্ষ উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে কার্যত ঢাকার মন ছুঁয়ে ফেরার বিমান ধরলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক শেষে, ঢাকার জন্য ঘোষণা করলেন একাধিক প্রকল্প। ‘বহুদলীয় বাধ্যবাধকতার’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিস্তা নিয়ে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামলানোর চেষ্টা করলেন। অন্য দিকে টিপাইমুখ নিয়ে তৈরি হওয়া সন্দেহের নিরসন করতে চেয়ে প্রস্তাব দিলেন, বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হোক। সব শেষে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উদ্দেশে প্রণববাবুর আশ্বাস, ভারত একতরফা ভাবে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। তাঁরা যেন ভারতের উপরে আস্থা না হারান।
আগামী কাল দিল্লি আসছেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি। তাঁর সফরের উপলক্ষও রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ উৎসবের সমাপ্তি। পাশাপাশি বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের সঙ্গে তিনি যৌথ উপদেষ্টা কমিশনের প্রথম বৈঠকে চেয়ারপার্সন হিসেবে যোগ দেবেন। জলসম্পদ মন্ত্রী পবন বনশলের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। |
ঢাকার গণভবনে শেখ হাসিনা ও প্রণব মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র |
বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসাবে প্রণববাবু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আজ যে দিগ্নির্দেশ দিয়ে গেলেন, আগামী কালের আলোচনায় তারই নিশ্চিত প্রতিফলন পড়বে।
আজ কী কী ঘোষণা করলেন প্রণববাবু?
১) ভারতের দেওয়া ১০০ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে ২০ কোটি ডলার ফেরত দিতে হবে না ঢাকাকে। সেটিকে অনুদান হিসাবেই দেখছে দিল্লি। বাংলাদেশ যে সব প্রকল্প চিহ্নিত করবে, সেগুলিতেই ব্যয় হবে ওই অর্থ।
২) এই ঋণের মধ্যে ইতিমধ্যেই ৬৩ মিলিয়ন ডলারের ৫টি প্রকল্প নিয়ে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি সই হয়ে গিয়েছে। ভারত থেকেই শ্রমিক ও যন্ত্র-প্রযুক্তি নেওয়ার শর্তও এখন শিথিল করা হচ্ছে।
৩) ৮০ কোটি ডলারের ঋণের সুদের হারও ১.৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে।
৪) যৌথ নদী কমিশনের অধীনে একটি সাব গ্রুপ তৈরি করা হবে, যারা টিপাইমুখের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখবে। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশ সরাসরি অংশও নিতে পারে।
৫) খুলনায় এনটিপিসি ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে চলেছে।
৬) ত্রিপুরায় পালটানায় যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশ সাহায্য করছে, তা থেকে তাদেরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়া হবে।
৭) শীঘ্রই বাংলাদেশকে রেলের কিছু কামরা ও লোকোমোটিভ ইঞ্জিন দেওয়া হবে।
আজ সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শেষ করে শেখ হাসিনার বাসভবনে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে বসেন প্রণববাবু। সঙ্গে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা ছাড়াও ছিলেন প্রসারভারতীর সিইও জহর সরকার। সেই বৈঠকে প্রণববাবু হাসিনাকে জানান, একতরফা ভাবে ভারত কখনওই এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি তিনি বলেন, প্রকল্পভিত্তিক যে ঋণ দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে আর বিলম্ব করা ঠিক নয়। এ বারে হাতে কলমে কিছু করে দেখাতে হবে। একই সঙ্গে হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রণববাবু জানান, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত-বিরোধী জঙ্গি সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রণববাবু বলেন, শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্নেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাসিনাও আজ মুক্ত কণ্ঠে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। প্রণববাবুকে বাংলাদেশের ‘পরম মিত্র’ হিসাবে একাধিক বার উল্লেখ করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গাঁধী তথা তৎকালীন ভারত সরকারের অবদানের কথাও কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন হাসিনা। বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গাঁধী যে ভাবে সহযোগিতা করেছেন, ভারত যে ভাবে আত্মত্যাগ করেছে তা আজও আমরা স্মরণ করি।”
দীপু মণি কাল যে যৌথ উপদেষ্টা কমিশনের আলোচনায় বসবেন, তা গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বাংলাদেশে গিয়ে উন্নয়ন সহযোগিতার যে চুক্তি সই করেছিলেন তারই অঙ্গ। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বছরে এক বার দু’দেশের যৌথ উপদেষ্টা কমিশনের বৈঠক বসবে। উদ্দেশ্য সহযোগিতার বিভিন্ন উদ্যোগ যথাযথ বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না খতিয়ে দেখা।
প্রণববাবু আজ দ্বিপাক্ষিক স্পর্শকাতর বিষয়গুলি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন বাংলাদেশ নেতৃত্বের সঙ্গে। সে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং সংবাদ চ্যানেলের সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি সীমান্ত সংঘর্ষ, ছিটমহল হস্তান্তর, তিস্তা চুক্তি--- কোনও বিষয়ই এড়িয়ে যেতে চাননি। তাঁর কথায়, “আমরা তিস্তা চুক্তির মতো বেশ কিছু বিষয়ের দ্রুত নিষ্পত্তি চাই। এটাও ঠিক যে আর্ন্তজাতিক চুক্তি রূপায়ণের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আবার বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকলকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হয়। বিশেষত শরিকদের। তাই ঐকমত্য তৈরি করতে কিছু সময় হয়তো লাগতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনও সন্দেহ রাখবেন না।”
দিল্লি ফেরার আগে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। গত কাল মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন বাংলাদেশে শাসক ও বিরোধী দলের লাগাতার দ্বৈরথ বন্ধ করে ‘পরিণত আচরণ’ করার পক্ষে জোরালো পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন। আজ প্রণববাবুও বলেছেন, “সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাতে দুর্বল না হয় সেটা দেখতে হবে। পারস্পরিক আলোচনায় সমস্যা মেটানোর অভ্যাস অনেক জটিলতা এড়াতে পারে।” |