স্বপ্ন দেখছেন দৃষ্টিহীন সুভাষ-সুমিতা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • শিলিগুড়ি |
‘প্রথম দেখা’ প্রকৃতিপাঠের শিবিরে। দৃষ্টিহীন দুই তরুণ,তরুণী। সুভাষ দে এবং সুমিতা হালদার। তাই প্রথম দেখা না বলে ‘প্রথম পরিচয়’ বলাই ভাল। দৃষ্টিহীন তাঁরা পরষ্পরকে দেখবেনই বা কী ভাবে? সুভাষের কথায় অবশ্য সেটাই তাঁদের প্রথম দেখা, অনুভূতি দিয়ে। অনুভূতির সেই সম্পর্ক এবার সাতপাঁকে বাঁধা পড়ল। শিলিগুড়ির ফুলেশ্বরীর বাসিন্দা সুমিতাকে বৃহস্পতিবার বিয়ে করলেন সুভাষ। কলকাতার বিডন স্ট্রিটের বাসিন্দা সুভাষ দে’র এই পরিচয়ই অবশ্য শেষ নয়। ব্লাইন্ড অপেরা নাটক দলে শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বিভিন্ন নাটকে এক সময় অভিনয় করতেন। এখন ‘অন্য দেশ’ নাটক দলে। অভিনয়ের পাশাপাশি সুভাষবাবু নিজেই এখন নাটক পরিচালনা করেন। ২০০৩ সালে ‘ডাকঘর’ এবং ২০০৫ সালে ‘আপনজন’ টেলিফিল্মের নায়কও। শিলিগুড়ির হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর সদস্য দীপজ্যোতি চক্রবর্তী তাঁর বন্ধু। সেই সূত্রেই আট বছর আগে দৃষ্টিহীনদের নিয়ে ন্যাফের প্রকৃতিপাঠের শিবিরে যোগ দিতে শিলিগুড়িতে এসেছিলেন তিনি। |
বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে বিয়ের ছবিটি তুলেছেন দীপঙ্কর ঘটক। |
লাটাগুড়িতে দীপজ্যোতিবাবুর রিসর্টেই প্রকৃতিপাঠের শিবিরে পরিচয় সুমিতার সঙ্গে। সেটাই সম্পর্কের শুরু। ক্রমেই দু’জন একে অপরের কাছে এসেছেন। শিলিগুড়ির ভারতনগর এলাকার বাসিন্দা সুমিতারা ৪ ভাইবোন। এক বোন এবং এক ভাইও দৃষ্টিহীন। বাবা দীপকবাবু ট্রাকের চালক। কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করছেন। পরিচয়ের পর থেকেই সুমিতাকে পড়াশোনার উৎসাহ জোগাতেন সুভাষ। তাঁরই চেষ্টায় কলকাতার বেহালায় ব্লাইন্ড স্কুলে ২০০৫ সালে ভর্তি হন সুমিতা। এ বছর সেখান থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন তিনি। সুমিতা বলেন, “আমার পড়াশোনার পিছনে ওর অবদান অনেক। বিয়ের পরেও পড়াশোনা করতে হবে বলে জানিয়েছে। আমিও রাজি।” মাস খানেক আগে সুমিতাকে বিয়ের বিষয়টি বন্ধু দীপজ্যোতিবাবুকে জানান সুভাষবাবু। আর সেই সঙ্গে বরযাত্রী যেতে আমন্ত্রণ। সুভাষবাবুরা ৪ ভাইবোন। আড়াই বছর বয়সে চোখের কোল ঘেঁষে ফোঁড়া হয়েছিল। চিকিৎসার ভুলে চোখের দৃষ্টি হারান সুভাষবাবু। সেই থেকে সংগ্রাম শুরু। বাবা জগদীশ চন্দ্রবাবু এবং মা প্রতিমা দেবীও সে সময় মারা যান। কাকা যোগেন্দ্র চন্দ্রবাবুর সংসারেই তার পর ভাইবোনরা মানুষ হন। কলকাতা ব্লাইন্ড স্কুল থেকেই পড়াশোনা। সিটি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। সোস্যাল ওয়ার্কে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস। সেই সঙ্গে চলতে থাকে অভিনয় চর্চাও। সেটাই এখন তাঁর জীবন এবং জীবিকা। এ দিন বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী এসে খুশি রাজা ফৈয়াজ আলম, শিবশঙ্কর প্রসাদ ভামারা। দৃষ্টিহীন তাঁরাও। ব্লাইন্ড স্কুলে পড়াশোনা থেকে নাটক দলে সুভাষের সঙ্গেই রয়েছেন তাঁরা। দু’ জনেই জানান, বন্ধু বিয়েতে এসে তাঁরা খুশি। বরযাত্রী এসেছেন শুভাশিসবাবু, সুভাষবাবুর দিদি লক্ষ্মী দাস, খুড়তুতো দাদা জয়ন্ত দে সকলেই। লক্ষ্মীদেবী বলেন, “বাবা, মা মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে ও বড় হয়েছে। আর পাঁচ জনের মতো ও সংসার করবে তা আমরাও আগে ভাবিনি। সুমিতাকে তাই বিয়ের প্রস্তাবের কথা যখন বাড়িতে বলে তখন সকলেই খুশি হয়েছি।” ন্যাফের উদ্যোগে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফি বছর বিভিন্ন জায়গায় প্রকৃতিপাঠের শিবির হয়। শিবির হয় সাধারণ ছেলেমেয়ের নিয়েও। তবে দৃষ্টিহীনদের নিয়ে আলাদা করে প্রকৃতিপাঠের শিবির গত ৮ বছর ধরে দীপজ্যোতিবাবুর রিসর্টেই হয়ে আসছে। সেখানে একাধিকবার সুমিতার সঙ্গে দেখা হয়েছে সুভাষবাবুর। মধুচন্দ্রিমার জন্য তাই এর চেয়ে উপযুক্ত জায়গা হবে না বলে মনে করেন সুভাষবাবু এবং সুমিতা দু’ জনেই। তাঁদের কথায়, “সেখানেই খুঁজে পাব আমাদের ফেলে আসা স্মৃতিকে।” দীপজ্যোতিবাবুকে তা জানাতেই এক কথাতেই রাজি। নিজের রিসর্টে নবদম্পতির মধুচন্দ্রিমার সমস্ত বন্দোবস্ত অগ্রিম করেও রেখেছেন তিনি।
|