বাসুদেব সার্বভৌম থেকে রঘুনাথ শিরোমণি, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ থেকে শ্রীমন্ত আচার্য। নব্যন্যায়, স্মৃতি, তন্ত্রের পীঠস্থান নবদ্বীপে পুথির কোনও আকাল নেই। কিন্তু উদাসীনতায়, অবহেলায় আর আর্থিক সমস্যায় মধ্যযুগের বিখ্যাত বিদ্যাতীর্থ নবদ্বীপের সেই সব পুথির অধিকাংশই আর পড়া যায় না। এমনকী, কোন পুথির বিষয় কী, কার লেখাসে সবেরও কোনও নথি পর্যন্ত নেই।
সেই নথি তৈরি করতে গিয়ে আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতার সামনে পড়েছেন গবেষকেরা। নবদ্বীপের মণিপুর অঞ্চলের এক পণ্ডিতের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা গিয়েছেন তাঁরা। সন্ধ্যার মুখে তাঁদের দেখেই আঁতকে উঠলেন ওই বাড়ির লোক। সংস্কৃতের শিক্ষক শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “আমরা তো অবাক। ওই বাড়ির লোক আঁতকে উঠলেন কেন? তারপরে শুনলাম পুথিগুলো রাখা রয়েছে উঠোনের পাশে সিঁড়ির কোণে ডাঁই করে। ওই বাড়ির লোক জানালেন, সেখানে সাপ রয়েছে। বহু দিন সেখানে কেউ হাত দেয়নি।” পাতা ছেঁড়া সেই সব পুথি বহুকাল ধরে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। তবে এ শুধু কোনও এক পণ্ডিতের বাড়ির ঘটনাই নয়। কাছাকাছি দৃশ্য দেখা গিয়েছে খাস সংস্কৃত কলেজের গ্রন্থাগারেও। ২০০০ সালের বন্যার জল ঢুকেছিল ওই গ্রন্থাগারে। পরের পর কাঠের আলমারি ভর্তি পুথি ছিল। পলিমাটি ভর্তি জল সেই আলমারি গ্রাস করে। তারপরে জল সরে গেলেও বহু দিন সেই আলমারি খোলা হয়নি। তারপরে এক দিন দেখা গেল, আলমারির দরজা এমন ভাবে আটকে গিয়েছে যে, কাঠের মিস্ত্রি এনে সেই দরজার পাল্লা খুলতে হয়। কিন্তু তারপরে দেখা গেল ভিতরের পুথিগুলি জমাট বেঁধে গিয়েছে। ছোট ছোট টুকরো খসে পড়ছে। সেই পুথি আর পুথি নেই। সেই কলেজই এখন বিলুপ্ত।
হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদে কেন এই অবহেলা? বিশেষজ্ঞেরা জানান, সংস্কৃতের কদর কমার সঙ্গে সঙ্গেই পুথিরও কদর কমেছে। অনেক জায়গায় পুথি পুজো করা হয়, কিন্তু জলের ছিটে, ভেজা ফুলের সংস্পর্শে এসে তাতে যে পুথির আখেরে ক্ষতিই হচ্ছে, সেই বোধটুকু পর্যন্ত নেই। বছর তিনেক আগে জাতীয় পাণ্ডুলিপি মিশনের উদ্যোগে কিছু নাড়াচাড়া হয়েছিল। তারপরে পুথি সম্পদের খবরাখবর আর কেউ রাখেন না। সেই সময়েই জানা গিয়েছিল, সাধারণ গ্রন্থাগার, নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ বা মহাপ্রভুর টোলবাড়ির মতো কিছু জায়গায় প্রাচীন পুথি রয়েছে।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “এই শহরে এক দিকে যেমন পুরাতন স্থাপত্যের কোনও নথিপত্র নেই, তেমনই নেই পুথির হিসাব। এখন দরকার, জাতীয় সম্পদ হিসেবেই যেটুকু পুথি এখনও পাওয়া যাচ্ছে, দ্রুত তা সংরক্ষণ ও নথিভুক্ত করা।” নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগারের সম্পাদক নিশীথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পাণ্ডুলিপি মিশন দু’শোটির মতো পুথি নথিভুক্ত করেছিলেন। তারপরে তাঁদের কাজের ধরনের সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য হয়। সেই থেকে আমরা নিজেরাই কাজ করছি।” জাতীয় পাণ্ডুলিপি মিশনের পক্ষে রত্না বসু বলেন, “মিশন তার মতো করেই সংরক্ষণের কাজ করছে। কিন্তু যা হারিয়ে গিয়েছে, তা আর কী করে ফেরত পাওয়া যাবে?” |