শনিবারের ম্যাচ সম্পর্কে তাঁর নাকি এমনই মনোভাব। আই পি এল পয়েন্ট তালিকা অনুযায়ী সফলতম অধিনায়কদের মধ্যে দু’নম্বরে। ব্যাটসম্যান হিসেবেও মারকাটারি খেলছেন। সেই গৌতম গম্ভীর অকপট সাক্ষাৎকার দিলেন। শাহরুখ, সৌরভ, কেকেআর টিম থিম এবং অবশ্যই ৫ মে-র ইডেন সম্পর্কে!
প্রশ্ন: দ্বিতীয় বছর হল কলকাতা শহরের অধিনায়কত্ব করছেন। কলকাতা বলতে কী বোঝেন?
গম্ভীর: বুঝি সিটি অব জয়। সব অর্থে। কারণ সব মানুষ এই শহরের বাসিন্দা যাঁরা উষ্ণ ভালবাসা দিতে জানেন। ইডেনে কেকেআর যেমন সমর্থন পাচ্ছে, আমি অভিভূত!
প্র: শহরটার কতটুকু চেনেন? ঘুরেছেন টুরেছেন?
গম্ভীর: কেকেআরের হয়ে খেলার সময় ঘোরার সুযোগ আর কোথায়? সারাক্ষণই কিছু না কিছু ব্যস্ততা থাকে। তবে প্রথম যখন রঞ্জি খেলতে আসি, আমি পার্ক হোটেলে উঠে ছিলাম। পার্ক স্ট্রিট চত্বরটা তখন হেঁটে ঘুরেছি। এর পর আবার যখন আসি, পিয়ারলেস ইন-এ ছিলাম। ওই এলাকাটাও হেঁটে ঘোরা।
আমি তো নিজের পরিবারকে বলেই দিয়েছি ভবিষ্যৎ জীবনে দিল্লির বাইরে যদি কোথাও আমাদের সেটল করতে হয়, তা হলে কলকাতা। শহরটার মধ্যে একটা এলিয়ে থাকা আমেজ আছে যেটা আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয়।
প্র: আমাদের অনেকের কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহ ছিল যে কলকাতা আপনাকে মেনে নেয় কি না? আফটার অল, আপনি তাদের প্রিয় দাদার বুটে পা গলিয়েছেন। আপনার মনে সন্দেহ ছিল না?
গম্ভীর: দেখুন ভাই, আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে গ্রহণ না করলে কিছু আসে যায় না। আমার টিমটাকে গ্রহণ করলেই হল। কেকেআর যেন বর্জিত না হয়, আমার ভাগ্যে যাই জুটুক। আমার বার বার মনে হয়েছে কলকাতার মানুষের মনোভাব হল, কেকেআর ভাল খেললে অবশ্যই তাকে সাপোর্ট করব। সে যে-ই ক্যাপ্টেন থাক। |
প্র: কেকেআর অধিনায়ক হিসেবে তা হলে প্রথম লক্ষ্যটা কী ছিল? যা আজও আপনার মনে কাজ করে?
গম্ভীর: বরাবর একটাই লক্ষ্য আমার প্রথম দিন থেকে। ক্যাপ্টেন হতে যেয়ো না, লিডার হতে চেষ্টা করো। ক্যাপ্টেন হল তো সে যে শুধুমাত্র মাঠে নেতৃত্ব দেয়। লিডার হল সে যে মাঠের বাইরেও নিয়ন্ত্রণ রাখে। চার দিকে যদি তাকান, দেখবেন ক্যাপ্টেন অনেক আছে। লিডার দুর্মূল্য।
আমি বরাবর ভাবতাম, কোনও দিন ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হলে লিডার হওয়ার চেষ্টা করব। টিমের বাচ্চাদের সঙ্গে থাকব মাঠের বাইরে। ওদের সুখে দুঃখে। আর চেষ্টা করব যাতে ওদের প্রতিভার পুরো বিকাশ ঘটাতে পারি।
প্র: শুনলাম মাঠের বাইরে আপনি সবচেয়ে বেশি সময় দেন সুনীল নারিনের পিছনে। উঠতি এক স্পিনার যাতে ঠিক রাস্তার সন্ধান পায়।
গম্ভীর: শুধু সুনীল নারিন কেন। ও তো স্পেশ্যাল ট্যালেন্ট নিশ্চয়ই। ইনদওরে প্রথম খেলতে গিয়েই মনে হয়েছিল এই ছেলেটাকে পেলে আমার কেকেআরে অনেক কাজ দেবে। কিন্তু নারিন তো তবু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। জীবন বলুন, ক্রিকেটসভ্যতা বলুন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের তবু একটা আইডিয়া থাকে। তোমার মূল লক্ষ্য যারা সেই গাড়িতে পা দিতে এখনও পারেনি। পথনির্দেশ তাদের সবচেয়ে বেশি দরকার। যেমন দাসি (দেবব্রত), ইকবাল আবদুল্লা, সামি আমেদ।
প্র: আপনি নাকি টিম থিম করেছেন, এমন ভাবে খেলবে যাতে তোমার জার্সির সামনে যা লেখা রয়েছে, সেটা জার্সির পিছনে অদৃশ্য ভাবে টগবগ করুক।
গম্ভীর: হ্যাঁ ।আমি বলেছি জার্সির পিছনেও যেন কেকেআর অদৃশ্য ভাবে জ্বলজ্বল করে। কেকেআর। যা কখনও আমি নই। শাহরুখ খান নয়। কেকেআর হল একটা গোষ্ঠী যারা এক সঙ্গে কাজ করে। যারা কখনও আমি নয়। আমরা।
প্র: গৌতম গম্ভীর বলতে কী বোঝায়?
গম্ভীর: বোঝায় যে লোকটা দলের জন্য খেলে। যে লোকটা বিশ্বাস করে সে কেউ নয়। যার জন্য সে খেলে, সেই গোষ্ঠীটা আসল। যে বিশ্বাস করে এক দু’জন নায়কে কখনও ধারাবাহিক জেতা যায় না। যদি নিয়মিত জিততে হয় একটা গ্রুপকে কিছু না কিছু পারফর্ম করে যেতে হয়। যে ছেলেটা জরুরি ২০ করল সে-ও আমার কাছে সেঞ্চুরি করা লোকটার সমান গুরুত্বের।
প্র: ভারতে তো ঠিক এ ভাবে দেখা হয় না। এখানে দৃষ্টিভঙ্গিটা অনেক বেশি তারকা কেন্দ্রিক।
গম্ভীর: সেটাই তো সমস্যা। আমাদের দেশে কেবল বড় পারফরম্যান্সেরই কদর আছে। তার ছায়ায় ঢাকা দিয়ে দেওয়া হয় তুলনায় ছোট অথচ ভীষণ প্রয়োজনীয় পারফরম্যান্সকে। অথচ ছোট ছোট অবদানকে আমরা স্বীকৃতি না দিলে কোনও দিন স্বার্থহীন, টিমের জন্য খেলা রপ্ত করাতে পারব না। সবাই নিজের নিজের বড় পারফরম্যান্সের জন্য খেলে যাবে। সবাই ভাববে বড় রান না করলে স্বীকৃতি পাব না। দলের জন্য স্বার্থত্যাগ করে কী হবে?
প্র: ক্রিকেটজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আপনাকে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে। ২০০৭ বিশ্বকাপে জায়গা পাননি। এর পর ইংল্যান্ড সফরে মুখ্য নির্বাচক বিদ্রুপ করে বলেছেন, কী রে দু’টো ওপেনার রান পেয়ে গেল। ওয়াসিম জাফর আর কার্তিক। তুই তো আবার বৈঠকী হবি! সেই সব হজম করে আপনি সসম্মানে ফেরত এসেছেন। কেকেআর কাহিনিও কি আপনার মতো হতে যাচ্ছে?
প্রথমে রক্তাক্ত। পরে বিজয়ী।
গম্ভীর: আমি ছোটবেলাতেই জানতাম আর কোনও রাস্তা নেই। আমাকে রক্তস্নানের মধ্যেই অনিবার্য ভাবে যেতে হবে। সেটাই যখন ঘটল, শুধু আমি ভাবতাম আমার হাতে কোনও দিন সুযোগ এলে তরুণদের একই ভাবে বিদ্ধ হতে দেব না। তাদের সঙ্গে আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে নিরন্তর ওয়ান অন ওয়ান যোগাযোগ রাখব। যে জিনিস আমি প্লেয়ার হিসেবে আমার কোনও ক্যাপ্টেনের কাছে পাইনি।
প্র: বিপ্লবী ভগৎ সিংহ নাকি আপনার আদর্শ?
গম্ভীর: আদর্শ কি না বলতে পারব না। তবে বড় হওয়ার সময় ওঁর জীবনীটা আমি আলাদা করে পড়েছিলাম। পড়ে খুব উদ্বুদ্ধও বোধ করি।
প্র: কাশ্মীর সীমান্তে নিয়মিত অহিংসা সৃষ্টিকারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ জিতে বদলা নেওয়া উচিত, এমন স্ট্রং মন্তব্য আপনি করেছিলেন শেষ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগে। খেলতে খেলতে এত স্ট্রং কথা ভাবাই যায় না। কেউ বলে না।
গম্ভীর: আসলে পাকিস্তান ছিল না কেবল ইস্যুটা। কাশ্মীরও না। আমি বলতে চেয়েছিলাম দেশের সামরিক বাহিনী নিয়ে। কাশ্মীরে যে ফৌজ দাঁড়িয়ে আছে তাদের নিয়ে। আমার কাছে ভারতীয় আর্মির চেয়ে বড় হিরো আর নেই। কেউ লাগে না আর্মির পাশে। সে সুপারস্টার ক্রিকেটার হোক। বলিউডের সম্রাট হোক। বা শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ।
আমার কাছে বীর জওয়ানরা সবার আগে। যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের রক্ষা করছেন। আর্মি অফিসার, লেফটেন্যান্ট, মেজর এঁরা। এঁদের পাশে কেউ আছে?
প্র: শাহরুখ খানের সঙ্গে আপনার ক্রিকেটীয় সমঝোতা কেমন?
গম্ভীর: শাহরুখ প্রথম দিনই আমাকে বলেছিল টিমটা এখন তোমার। পারলে জেতাও। নইলে উচ্ছন্নে দাও। সবটাই তোমার হাতে।
আমি শাহরুখের একটা জিনিস অসাধারণ বলব। গত দু’বছর এমন সব দুর্যোগের মধ্যে টিম গেছে। ও কখনও ক্রিকেটীয় কোনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেনি। মালিক হিসেবে অনায়াসে নাক গলাতে পারত। কিন্তু করেনি। নিজে এত বড় পারফরমার বলেই হয়তো জানে পারফরম্যান্সের ওঠা নামা জীবনে থাকেই।
প্র: সচিন তেন্ডুলকরের রাজ্যসভায় যাওয়া নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে চার দিকে। আপনি মুখ খোলেননি কেন?
গম্ভীর: না, এটা আর কী বলব। যোগ্যের যোগ্য সম্মান।
প্র: আপনার কি মনে হয় সচিনের এই পথকে কাজে লাগিয়ে সমাজের জন্য অনেক কিছু করা উচিত? হয়তো বা ক্রিকেট থেকে অবসরের পরে?
গম্ভীর: সেটা আমি কী করে বলব! সেটা তো যার যার নিজের ওপর।
প্র: আপনি নিজে ভেবেছেন খেলা ছাড়ার পর সমাজের জন্য কিছু করবেন বলে?
গম্ভীর: কিছু করতে চাই তো নিশ্চয়ই। মানুষের জন্য করতে চাই।
প্র: তার মানে গৌতম গম্ভীরের পরের স্টেশন রাজনীতি?
গম্ভীর: তা কেন! মানুষের জন্য করতে হলে রাজনীতি দিয়েই আসতে হবে কেন।
প্র: কারণ রাজনীতি অনেক বেশি লোকের জন্য করার সেই ক্ষমতাটা দেয়।
গম্ভীর: আমি ক্ষমতা চাই না। মানুষের উপকার চাই। ক্রিকেট খেলে সেটা তো যায় না। ক্রিকেট একটা জায়গায় গিয়ে থেমে যায়। ক্রিকেট মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তাদের অবস্থা বদলে দিতে পারে না।
আমাকে তাই যখন ইন্টারভিউতে জিজ্ঞেস করা হয় আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটা? তখন আমি বলি স্মরণীয় মুহূর্ত এখনও আসেনি।
প্র: কেন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মুহূর্তটা?
গম্ভীর: না, ওটাও দেশের মানুষকে অসম্ভব সুখ দিয়েছিল। সমাজকে বদলে দিতে পারেনি। তার অবস্থানের কোনও উন্নতি করতে পারেনি।
প্র: শুনছি ইডেন পিচ নিয়ে আপনি রোজ ভয়ঙ্কর অসন্তুষ্ট থাকছেন। এসআরকে-র মাধ্যমে চাপ দিচ্ছেন না কেন সিএবি-কে?
গম্ভীর: ডাহা বাজে কথা যে আমি পিচ নিয়ে ক্ষুব্ধ। আমি মনে করি যা সার্ফেস পাচ্ছি তাতেই আমাদের খুশি মনে মানিয়ে খেলা উচিত। মিডিয়া কেন যে এই অপপ্রচারটা করছে!
প্র: ৫ মে নিয়ে যা আবেগ তৈরি হয়েছে অভূতপূর্ব। বলা হচ্ছে আাইপিএল গ্রহ এমন সাড়া জাগানো সাক্ষাৎ কদাপি দেখেনি।
গম্ভীর: স্রেফ মিডিয়া হাইপ। আরে এখনও ক্রিকেট খেলাটা হয় এগারো বনাম এগারো। কোনও এক জনের বিরুদ্ধে নয়। সেই এগারোর মধ্যে যারা ভাল খেলে তারা জেতে। ৫ মে-ও তাই হবে। আলাদা করে ম্যাচটা নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করব কেন?
এর আলাদা কোনও তাৎপর্য আমার কাছে নেই। ক্যালেন্ডারে ৩০ এপ্রিল যা। ৩ মে যা। ৫ মে-ও তাই।
প্র: সৌরভ আর আপনার মধ্যে প্রচুর মিল রয়েছে। ক্রিকেট জীবনে পাওয়া বঞ্চনা থেকে আপনার আক্রমণাত্মক মনোভাব, সবেতেই।
৫ মে-র বিপক্ষ অধিনায়ক সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন?
গম্ভীর: ওর রেকর্ডই তো ওর হয়ে কথা বলে। ভারতের গুটি কয়েক লিডারের মধ্যে সৌরভ পড়ে।
তবে একটা কথা আমি বলি। আমি গ্রেট ক্যাপ্টেনের তত্ত্বে একদম বিশ্বাসী নই। গ্রেট ক্যাপ্টেন বলে কিছু হয় না।
প্র: তা হলে কী হয়?
গম্ভীর: হয় গ্রেট টিম। যারা ক্যাপ্টেনকে জিতিয়ে গ্রেট বানিয়ে দেয়।
প্র: আপনি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী?
গম্ভীর: আবার কী! একটা টিম ততটাই ভাল যতটা ভাল তার অধিনায়ক। রিকি পন্টিংকে দেখুন না। জ্বলন্ত। যখন ম্যাকগ্রা আর ওয়ার্ন সঙ্গে ছিল লোকে বলত কী ক্যাপ্টেন। যে-ই ওরা চলে গেল ক্যাপ্টেন্সি কোথায় গেল বাবা। একই তো লোক। একই মাথা। স্রেফ গড়াগড়ি খেল। |