মহাযুদ্ধের আগে ধাক্কা খেলেন সৌরভরা
সহজ ম্যাচ হেরে শেষ চারের দৌড় থেকে প্রায় বিলীন পুণে
পুণে ওয়ারিয়র্স লাউঞ্জের প্রথম সারি মনে হল সার দিয়ে নীরবতা পালন করছে। মাঠের এক দিকে তখন চরম তৎপরতা। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের রিজার্ভ প্লেয়াররা দৌড়ে স্টাম্প তুলে নিচ্ছেন। যেন টেস্ট ম্যাচ জয়ের স্মারকচিহ্নের মতো বাড়িতে রেখে দিতে চান। আর এ দিকে সুশান্ত রায়-অভিজিৎ সরকার-সহ সহারা ক্রিকেট কর্তারা চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে। এ দিন অধিনায়কের সঙ্গে বারদুয়েকের আলোচনায় বসে তাঁরা টুর্নামেন্টে নিজেদের সেরা দল নামিয়েছিলেন। আর তারাই কিনা সহজ টার্গেট দূরের পশ্চিমঘাট পাহাড়ে ছুড়ে ফেলে দিল!
আইপিএল মহাকর্তা সুন্দর রমন আশা করা যায় এতক্ষণে টুইট করে ফেলেছেন, ‘আইপিএলের আরও একটা সরবিট্রেট-স্পেশ্যাল ম্যাচ। সেই শেষ বলে গিয়ে কিনা ফয়সালা হল।’ আদতে সরবিট্রেট কেন, কোনও ট্যাবলেটই দরকার ছিল না। সারফেসে বল কিছুটা ঘুরছিল ঠিকই, কিন্তু ১২১ রান তাড়া করে স্বচ্ছন্দে জেতা যায়। শেষ বল যখন হচ্ছিল পুণের জেতার জন্য চাই চার রান। লাউঞ্জে তখন জোর আলোচনা হচ্ছে মুনাফ, আর একটা চেতন শর্মা দাও...দাও। চেতন যেমন মিয়াঁদাদকে ব্যাটের গোড়ায় ফুলটস দিয়েছিলেন, মুনাফ তা করেননি। ইনি দিলেন দু’রান। দিয়ে সেমিফাইনালের দৌড় থেকে আরও বিলীন করে দিলেন পুণেকে। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে এমনিতে ফেভারিট বলে কিছু হয় না। তবু মনের জোরকে আরও পঙ্গু করে দেওয়া এ রকম ম্যাচের পর পুণের প্রতিপক্ষ দলকেই শনিবার ইডেনে অবিসংবাদী ফেভারিট দেখাচ্ছে।
স্বপ্নভঙ্গের মুহূর্ত। বোল্ড সৌরভ। বৃহস্পতিবার পুণেতে।
এগারো নম্বর ম্যাচে গিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে নীচে নামালেন। হয়তো আরও আগেই নামাতে পারতেন। এ দিনের জেতা ম্যাচ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি নিজে-সহ টিমের তিন জন অভিযুক্ত হবেন। জেসি রাইডার। যিনি জঘন্য একটা শট খেলে হরভজনকে ম্যাচে ফিরে আসতে দেবেন। রবিন উথাপ্পা। যাঁর উচিত ছিল আজ টিমকে টানা। আর অবশ্যই সৌরভ নিজে। ২৪ বল খেলে করা ১৬ পুণের সম্ভাবনাকে আরও বিক্ষত করে দেয়। এই টিমে পিঞ্চ-হিটার হিসেবে যিনি নির্ভরযোগ্য, সেই স্টিভ স্মিথ আজ রান পাননি। আর স্মিথ রান না পেলে মিঠুন মানহাস (৪২ ন.আ.) যতই ভাল খেলুন, একার পক্ষে ম্যাচ জেতানো সম্ভব নয়। পুণে ব্যাটসম্যানরা যদি এ বারের টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি ডট বল খেলার জন্য কুখ্যাত হয়ে থাকেন, তা হলে সবচেয়ে বেশি ডট বল করার কীর্তিমান লাসিথ মালিঙ্গা। তাঁর শেষ দুটো ওভার মুম্বইকে আরও জিতিয়ে দিল। একটা ওভারের শেষ বলে সৌরভকে বোল্ড করলেন। আর একটা ওভারে মাত্র ৪ রান দিয়ে তুলে নিলেন পার্নেলকে। এনার্জি, বুদ্ধি আর চমক দেওয়ার দক্ষতা এই ত্রিভুজকে সম্বল করে হরভজনের এই মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে উত্থান হয়েছিল পুণের। এখনকার লেখচিত্র পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার মতো নীচের দিকে। পয়েন্ট তালিকায় আট নম্বরে। শেষ পাঁচটা ম্যাচে চারটে জিততে পারবেন এমন আশা নিশ্চয়ই সৌরভও করছেন না।
সহারার অন্যদের সঙ্গে টিমের সঙ্গে যুক্ত রণদেব বসুকেও দেখলাম মূহ্যমান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই অবশ্য রণদেবের টেনশন শুরু হয়েছে। যখন কোনার সিটটায় বসে ধড়ফড় করে উঠলেন, “ওরে দিন্দা, কী দরকার ছিল?” দিন্দার বলে তখনই সচিন হাল্কা ক্যাচ তুলেছিলেন। সিলি মিড অফে বলটা পড়ে। দিন্দা উত্তেজিত ভাবে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা স্টিভ স্মিথকে দেখালেন ক্যাচটা নিলে না? স্মিথ হাত দিয়ে দূরত্বটা দেখাচ্ছেন। দিন্দার উত্তেজনা কমছে না। আগের ওভারেই সচিনকে ছ’টা ডট বল করেছেন। তার পর এই ঘটনা। উত্তেজিত ভাবে তখনও তিনি কোমরে হাত দিয়ে বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে। যেন ফিল্ডারের জবাবদিহি চাইছেন। শুধু রণদেব কেন, ডাগআউটে বসে থাকা দীপ দাশগুপ্তরও নিশ্চয়ই মনে পড়ে গেল বছরকয়েক আগে ওয়াংখেড়ের একটা বিকেল। যখন সচিনকে একটা বাউন্সারে পরাস্ত করে দিন্দা ব্যাটসম্যানের মুখের কাছে চলে গিয়েছিলেন। প্রায় গোটা টিম আর্তনাদ করেছিল, ওরে যাস না। সে বারের রঞ্জি ফাইনালিস্ট অধিনায়ক-সহ বাকি বাংলা টিম আজও দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ওই দৌড়ে যাওয়াটা না ঘটলে হয়তো সে দিনের সেঞ্চুরিটার জন্য সচিন এত উজ্জীবিত হতেন না।
সচিনকে ফিরিয়ে নেহরা। বৃহস্পতিবার।
এ দিনও পরিণতিটা সেই ওয়াংখেড়ের দিকেই যাচ্ছিল। দিন্দাকে এরপর টানা বাউন্ডারিতে যেন সেঁকে দিলেন সচিন। এমনিতে সুব্রত রায় স্টেডিয়ামের আশপাশটা পাহাড় ঘেরা। অদ্ভুত নির্জনতা আছে। প্রচুর খোলা ফাঁকা জায়গা বলে রাত্তিরে একটা রহস্য-রহস্য ভাবও আছে। ব্যোমকেশের দুর্গরহস্য নিয়ে যদি কেউ কোনও দিন ছবি করেন, তা হলে তিনি অনায়াসে পুণে-মুম্বই হাইওয়ের এই জায়গাটা বাছতে পারেন। কামানের ভিতর মোহর, তার খোঁজে সাধু, মণিলাল মাস্টার, ইতিহাসবিদ, সবই খাপে খাপ হয়ে যাবে। শুধু যে দিন সচিন এ মাঠে খেলবেন, রহস্যের র-ও থাকা সম্ভব নয়। সারাক্ষণ তাঁর সম্মানে এমন আওয়াজ। সকালে দেখলাম বাংলার প্রাক্তন মিডল অর্ডার শ্রীকান্ত কল্যাণী ছেলেকে নিয়ে এসেছেন সচিনের অটোগ্রাফ নেবেন বলে। ম্যারিয়ট হোটেলের সিনিয়র ম্যানেজার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরও সচিনের বইতে অটোগ্রাফ দরকার। দাঁড়িয়ে আরও অসংখ্য অনুরাগী। কেউ কাছে পৌঁছতে পারছেন না। শ্রীকান্ত কল্যাণী শেষে পরস মামরেকে পাকড়াও করে নিয়ে গেলেন। “দে না ছেলেটাকে একটু সই করিয়ে দে।” আন্দাজ করতে সমস্যায় পড়ছিলাম, পুণে দর্শক সচিনের বিরুদ্ধে ব্যারাকিং করবে কি না? ব্যারাকিং তো দূরে থাক, ৩৫ বলে ৩৪-এর পথে পুণে ওয়ারিয়র্স লাউঞ্জ অবধি বারবার লাফিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাল। আর পাঁচটা দিনের মতো মাঠ জুড়ে চিৎকার হল, ‘সচিন, সচিন।’ এক-এক সময় মনে হচ্ছিল ওয়াংখেড়েতেই হচ্ছে খেলাটা। শুধু তার সঙ্গে একটা নতুন সম্বোধন যোগ হল। নেতা-জি!
এমনিতে আইপিএলের সর্বকালীন হিসেবে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সচিন আছেন চার নম্বরে। মোট রান এবং স্ট্রাইকরেট দুইয়ের বিশ্লেষণে তাঁর আগে যথাক্রমে সহবাগ, রায়না আর গম্ভীর। ক্লাসের তিনি ফোর্থ বয়। বিষ্যুদবারের রাতে অবশ্য মনে হচ্ছিল এই সমবেত গর্জনের সম্মানে একাই ম্যাচটা নিয়ে যাবেন। শুধু মাঝখানে কার্তিককে দিলস্কুপ করতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড শর্টলেগে ক্যাচ উঠে গিয়েছিল। আশিস নেহরা সেটা ধরায় বিশেষ তৎপরতা দেখাননি।
সচিন: ৩৪ বলে ৩৪।
এই সময়ে তীব্র গুঞ্জন শুনলাম পুণে বক্সে যে, নেহরার নতুন নামকরণ হয়েছে এসকর্ট সার্ভিস। যার কাজ বলকে এসকর্ট করে বাউন্ডারিতে নিয়ে যাওয়া। প্রথম ওভারে মারও খেয়ে গেছেন তিনি। তখন কর্তাদের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে, হতে পারে এই আইপিএলে অদ্যই তাঁর শেষ রজনী। দুপুরে যে প্রাথমিক দল নির্বাচন হয়েছিল তাতে নেহরা ছিলেনও না। বাদ পড়ে নাকি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সেই দল আবার বদলানো হয়। ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক আর সৌরভ মিলে নতুন দল গড়েন। ঠিক হয়, আজ হাতে বোলার বেশি রাখতে হবে। কারণ গত তিনটে ম্যাচে ইনিংসের শেষ দিকে শুধু বেশি রানই যায়নি, রান ‘লিক’ হয়েছে। বাদ পড়ে দলে ঢোকা নেহরা একটা সময় পর্যন্ত তাই পুণের সবচেয়ে ঘৃণ্য মানুষ। ক্যাপ্টেন যাঁকে দলে নিলেও ঠিক করেছেন শেষ ওভারগুলো করাবেন না। মাঝে শেষ করে দেবেন। আর ঠিক এই সময়ই নেহরা তাঁর অত্যাশ্চর্য কামব্যাক শুরু করলেন। রোহিত শর্মা রান আউট হওয়ায় ছন্দটা নষ্ট হব-হব করছিল। কিন্তু তখনও মুম্বই ৮১-২। হাতে প্রচুর ওভার এবং এক রকম অনিবার্য দু’পয়েন্ট। সেখান থেকে তারা অদ্ভূত ধসে পড়ল ৯৩-৬-এ। সচিনকে যে বলটায় নেহরা আউট করলেন, ম্যাচের সেরা ডেলিভারির কোনও পুরস্কার থাকলে এটাই সেই পুরস্কার পেত। এর পর হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দেওয়া স্পেলে তিনি মুম্বইকে চুপসে দিলেন। দিনের শেষে কিন্তু নেহরার স্পেল সেই বিয়োগান্তই থেকে গেল। বেঙ্গালুরতে তিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন। এখানে উড়িয়ে দিলেন ব্যাটসম্যানরা। যা পড়ে থাকল, তা হল ইডেন ম্যাচের জন্য আবেগ। যুক্তি নয়।

ছবি: এএফপি




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.