পরনে আকাশি রঙের জামা, গাঢ় রঙের প্যান্ট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত চেহারায় অ্যালেক্স পল মেনন জনসমক্ষে এলেন দীর্ঘ ১৩ দিন পরে। মাওবাদীদের হাতে অপহৃত সুকমার জেলাশাসককে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরে চলা উৎকণ্ঠা ও সংশয়ের পরিসমাপ্তি ঘটল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ছাড়া পেয়েই বললেন, “আমি ভাল আছি। আমাকে সরকারকে যেখানে পোস্টিং দেবে, সেখানেই কাজ করব। সরকার চাইলে সুকমাতেই কাজ করব।”
মেননের মুক্তির পরই সন্ধ্যায় রায়পুরে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ বলেন, “জেলাশাসকের মুক্তির খবর পাই সন্ধ্যা ছ’টা পঞ্চান্ন মিনিটে। আর সাতটায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিকে কাজ শুরুর আদেশ দিই।”
মেননের মুক্তি নিশ্চিত করতে বন্দি মাওবাদীদের ছাড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য গঠন করা হয়েছিল এই কমিটি। বৃহস্পতিবারই রায়পুর জেলা আদালতে দুই মাওবাদী নেত্রী মীনা চৌধুরি এবং শান্তিপ্রিয়া রেড্ডি ওরফে মালতির জামিনের আর্জি জানায় সরকার। ২০০৮-এ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
এসএমএস বার্তায় মাওবাদীরা আগেই জানিয়েছিল, মেনন মুক্তি পাবেন বৃহস্পতিবার। সেই মতো এ দিন সকালেই রায়পুর থেকে চিন্তলনাড় হয়ে টারমেটলার জঙ্গলে মাওবাদী ডেরায় যান তাঁদের তরফের দুই মধ্যস্থতাকারী বি ডি শর্মা এবং অধ্যাপক জি হরগোপাল। এর খানিক পরে টারমেটলার দিকে যান আদিবাসী মহাসভার সভাপতি তথা সিপিআই নেতা মণীশ কুঞ্জমও। এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেননি তিনি। যদিও বেশি রাতে আনন্দবাজারকে ফোনে মণীশ বললেন, “আমি গিয়েছিলাম মধ্যস্থতাকারীদের আমন্ত্রণে। কিছুক্ষণ থেকে চলে আসি।” |
প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছিল এ দিন দুপুরেই ছাড়া পাবেন মেনন। কিন্তু দুপুরের পর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। চিন্তলনাড়ে অপেক্ষায় থাকা সংবাদমাধ্যম এবং রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা তখনও বুঝতে পারছিলেন না বহু প্রত্যাশিত সেই মুর্হূতটি আসবে কখন।
প্রস্তুতি ততক্ষণে চরমে। চিন্তলনাড় বেস ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ‘পজিশন’ নিয়েছেন ‘ক্যামুফ্ল্যাজ’ পোশাক পরিহিত সিআরপিএফ জওয়ানরা। জঙ্গলের পথে দাঁড়িয়ে মাইন-রোধী গাড়ি। চিন্তলনাড় বেস ক্যাম্পের হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে কপ্টার। জগদলপুর হেলিপ্যাডেও ততক্ষণে এসে গিয়েছে আরও দু’টি কপ্টার।
কিন্তু মেনন কোথায়? ছত্তীসগঢ় রাজ্য পুলিশের আই জি মুকেশ গুপ্ত তখন টেলিফোনে আনন্দবাজারকে বলছেন, “হ্যাঁ, মেনন মুক্তি পাচ্ছেন, কিন্তু যতক্ষণ না জেলাশাসকের মুখ দেখতে পাচ্ছি, ততক্ষণ পুরো পর্ব সমাধা হয়েছে, বলি কী করে!” যে সাংবাদিকদের সকালে মাওবাদীরা চিন্তলনাড়ে আটকে দিয়েছিল, সেই সাংবাদিকদেরই আচমকা ডাক পড়ল বিকেলে। মাওবাদীদের বার্তা এল, যেতে হবে টারমেটলা। মেননকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে সেখানে। দ্রুত সাংবাদিকরা রওনা দিলেন টারমেটলার দিকে। এর কিছু আগে মধ্যস্থতাকারীদের গাড়ির সঙ্গেই পাঠানো হয়েছিল চিকিৎসক-সহ একটি অ্যাম্বুল্যান্স। কিন্তু মাওবাদীরা সেটি ফেরত পাঠিয়ে দেয়। মাওবাদীরা জানাল, ভাল আছেন মেনন। তিনি গাড়িতেই যেতে পারবেন। বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।
চিন্তলনাড় থেকে টারমেটলার দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। দিনের আলো তখন মরে এসেছে। সাংবাদিকদের গাড়ির সঙ্গেই একটি সাদা বড় গাড়িতে চালকের পাশে বসে চিন্তলনাড় পৌঁছলেন মেনন। অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সামনে রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রী, সিনিয়র অফিসার এবং সংবাদমাধ্যমকেও ধন্যবাদ জানালেন তিনি। তাঁর বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে অন্যতম মধ্যস্থ বি ডি শর্মা ডান হাত দিয়ে মেননকে কার্যত আগলে রেখে বললেন, “ওকে একটু আরাম করতে দিন। ও বড় ক্লান্ত।” পরে চিন্তলনাড় বেস ক্যাম্পে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে মেনন বললেন, “এই প্রতিকূল অবস্থায় আমার ও আমার পরিবারের পাশে থাকার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। আমি ক্লান্ত, বিশ্রামের প্রয়োজন। কাল সকালে কথা হবে।” নিরাপত্তার কারণেই বৃহস্পতিবার মেননকে সুকমায় পাঠানোর ঝুঁকি নেয়নি প্রশাসন। ঠিক হয় মেনন রাতটা চিন্তলনাড় বেস ক্যাম্পেই কাটাবেন। এ কথা শুনে মেননের স্ত্রী আশার মা আনন্দবাজারকে ফোনে বললেন, “রাতে কোনও রকম ঝুঁকি না নিয়ে ভালই হয়েছে।”
আর আশা বললেন, “আমরা খুশি। রাজ্য প্রশাসন থেকে শুরু করে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।” |