স্কুলের স্টাফরুমে ঢুকে ছাত্রীর মা হুমকি দিচ্ছেন, “আজ যদি বাড়ি গিয়ে মেয়ে ওর স্বামীর কাছে ফিরে না-যায়, তা হলে আমি আত্মহত্যা করব। আর এর জন্য কিন্তু দায়ী থাকবেন আপনারা।”
মাকে বাঁচাবেন? না অষ্টম শ্রেণির ‘ফার্স্ট গার্ল’ সুপ্রিয়া হালদারের বই-খাতা-কলমে বিভোর ‘স্বপ্ন’কে লালন করবেন? শ্বশুরবাড়ি কোনও ভাবেই ফিরে যাবে না বলে মায়ের সামনেই শিক্ষিকাদের কাছে কাতর মিনতি জানাতে থাকে চোদ্দো বছরের নাবালিকা। পড়াশোনা করে বড় হতে-চাওয়া মেধাবী ছাত্রীকে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জেদেই সুপ্রিয়া আর তার মা তুলাকে নিয়ে বুধবার পুলিশের দ্বারস্থ হন ‘হালতু হাইস্কুল ফর গার্লসে’র শিক্ষিকারা।
শ্বশুরবাড়িতে কোনওভাবেই যাতে ওই নাবালিকাকে পাঠানো না-হয়, তার আর্জি জানিয়ে পুলিশের কাছে শিক্ষিকারা আর্জি জানান, সুপ্রিয়াকে স্কুলের কাছাকাছি একটি হোমে রাখার ব্যবস্থা করা হোক।”
|
সুপ্রিয়া হালদার।
নিজস্ব চিত্র |
পুলিশের সঙ্গেই শিক্ষিকারা যান সমাজকল্যাণ দফতরের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিতে (সিডব্লিউসি)। সেখান থেকে সুপ্রিয়ার ঠিকানা বদলে হয়েছে হালতুর স্কুলের কাছেই একটি সরকারি হোম। সেখান থেকেই আপাতত স্কুলে যাতায়াত করবে সুপ্রিয়া। নিজের ইচ্ছে-স্বপ্ন ফিরে পেয়ে আত্মবিশ্বাসী ছাত্রী বলল, “মা-বাবা তো বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল! জোর করে বিয়ে দিয়েছিল! দিদিমণিরাই বাঁচিয়েছেন। আমি পড়ব। নিজের পায়ে দাঁড়াবই।” সুপ্রিয়ার গত এক বছরের লড়াইয়ের শরিক শিক্ষিকারাও বললেন, “এত ভাল মেয়ে। ওকে পড়াতেই হবে। ওকে হারতে দেব না। ওর অসম্ভব জেদ।”গরফার পূর্বাচল মেন রোডে দরমার চিলতে ঘরে তিন ভাইবোনের বড় মেয়ে সুপ্রিয়াকে গত জুনে ‘জোর করে’ই বিয়ে দিয়ে দেন তার রিকশাচালক বাবা আর পরিচারিকা মা। সুপ্রিয়া তখন সপ্তম শ্রেণি। ক্যানিংয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রিকশাচালক স্বামী সুজিত মণ্ডল তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালাত বলে নাবালিকার অভিযোগ। ঘরে বন্ধ করে রেখে অত্যাচার করতেন শ্বশুর-শাশুড়িও। কাঁদতে কাঁদতে সুপ্রিয়া এদিন বলল, “স্কুলে যেতে চাইলে মারত। মা-বাবার কাছে আসতে দিত না। মা একদিন জোর করেই নিয়ে এসেছিল আমায়। অনেক অশান্তি হয়েছে। রোজ আমাকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা হত। আমি যাইনি।” বরং শাঁখা-পলা খুলে সে ফিরে গিয়েছিল ঘিয়ে শার্ট আর খয়েরি স্কার্টের স্কুল ইউনিফর্মে। তার বই-খাতা-কলমের জগতে। গত অগস্ট থেকে স্কুলে ফিরে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে সুপ্রিয়া।
পড়াশোনায় বুঁদ সুপ্রিয়াকে আবার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন তার মা-বাবা। সঙ্গে স্বামীও। নিত্য অশান্তিতে পড়াশোনায় মন বসাতে না-পেরে অসহায় মেয়েটি সব ঘটনা জানায় তার শিক্ষিকাদের। শিক্ষিকারা সুপ্রিয়ার অভিভাবককে ডেকে একবার বলেনও মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি না-পাঠাতে। কিন্তু তার পর এ দিনের ঘটনাপ্রবাহে বাধ্য হয়ে সুপ্রিয়াকে নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হন তাঁরা। মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে পেরে বাংলার শিক্ষিকা স্বাগতা রায়চৌধুরী বলছিলেন, “আইনি ভাবে বিয়েও হয়নি মেয়েটির। অনেক বোঝানো সত্ত্বেও ওর মা-বাবা ওর জীবনটা শেষ করে দিতে চাওয়ায় পুলিশের কাছে যেতেই হল আমাদের।” লড়াকু মেয়েটির মুখে সব ঘটনা শুনে সিডব্লিউসির প্রাক্তন চেয়ারপার্সন অমিতা সেন বলেছেন, “নাবালিকা মেয়ের বিয়ে এবং তার উপর যে শারীরিক নির্যাতন হয়েছে, তা আদতে ধর্ষণ। পুলিশকে বলা হয়েছে যথাযথ ভাবে এফআইআর দায়ের করতে।”
সন্ধ্যায় মা-বাবার ঘর থেকে নিজের বইখাতা-জামাকাপড় নিয়ে স্কুলের পাশের হোমে চলে এসেছে সুপ্রিয়া। শুরু হয়ে গিয়েছে তার পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নতুন লড়াই। |